ভেষজ আবীর বানানোর পদ্ধতি: দেখতে দেখতে শীতের আমেজ কাটিয়ে উঠে বসন্তের আগমন ঘটেছে। আর এই বসন্তে চারিদিকে পলাশ, শিমুলের ছড়াছড়ি। সামনেই দোল, রঙের উৎসবের জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকেন ভারতবাসীরা। এছাড়া শুধুমাত্র ভারতেই নয়, দেশের বাইরেও দোল উৎসবে মেতে ওঠেন সেখানকার মানুষজন এবং অনেক বিদেশীরাও।
দোল বা হোলিতে সবচেয়ে প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের রং, তাইতো এই উৎসবকে রঙের উৎসব বলা হয়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বাজার জাত রং পাওয়া গেলেও আবিরই এই উৎসবের সকল ঐতিহ্যকে ধরে রাখে।
তবে বাজার থেকে কিনে আনা আবির অথবা রং তার মধ্যে থাকে বিভিন্ন রাসায়নিক এবং সিন্থেটিক রঞ্জক। যেগুলি আমাদের চোখ, মুখ, ত্বক, শরীর এবং চুল সবকিছুকে বিশেষভাবে ক্ষতি করে, যা ত্বক ও পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকারক তো বটেই এছাড়া বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েরাও এই উৎসবে মেতে ওঠে, তাদের জন্য এটা কতখানি সুরক্ষিত তা নিয়ে যদি আমরা একটু ভেবে দেখি, তাহলে সব দিক থেকে আমরা সুরক্ষিত থাকতে পারি।
যদি রং অথবা আবির সবকিছুই হয় প্রকৃতির ছোঁয়ায়, তাহলে সেই দোল খেলাতে আনন্দের সীমা থাকবে না। ধরুন রঙের উৎসবে চারিদিক থেকে ফুলের বর্ষণ হচ্ছে, কেমন লাগবে আপনার ? নিশ্চয়ই হারিয়ে যাবেন স্বর্গরাজ্যে, তাই তো !
তবে হ্যাঁ, এটা শুধু মনে হওয়ার কথা নয়, আপনি চাইলেই বাড়িতেই বানিয়ে ফেলতে পারেন প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি ফুল দিয়ে আবির। এই আবির দিয়ে রং খেলতে ভীষণই মজা লাগবে, আর ইচ্ছে করেই কিন্তু এই রং মাখতে চাইবেন সকলেই। “খেলবো হোলি রং দেব না তাই কখনো হয়, এসো এসো বাইরে এসো ভয় পেয়ো না ভয়”, তবে হ্যাঁ, ফুল দিয়ে তৈরি আবির দিয়ে যদি রং খেলা যায় তাহলে আর ভয় কিসের, এতে তো আনন্দ হওয়ারই কথা।
তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক, কিভাবে ফুল দিয়ে বাড়িতে বানিয়ে ফেলতে পারে বিভিন্ন রঙের আবির:
১. লাল রংয়ের আবির:
লাল রং বিশেষভাবে নজর কাড়ে, আর হোলিতে লাল রঙের আবির থাকবে না তা কি কখনো হয় ? জবা ফুল শুকিয়ে গুঁড়ো করে লাল রঙের আবির বানাতে পারবেন সহজেই।
এছাড়া লাল চন্দনের গুঁড়ো সেই সঙ্গে মিশিয়ে বা আলাদা করেও তৈরি করতে পারেন। এটি যেমন ত্বকের জন্য ভালো তেমন চন্দনের সুবাস থাকবে সারা শরীরে। একেবারে টকটকে লাল না হলেও লাল ভাব থাকা এই ফুলের আবির আপনাকে রং খেলতে বাধ্য করবে।
সদ্য বিবাহিতরা দোলের দিন এগুলি ভুলেউ করবেন না, মা লক্ষ্মী অসন্তুষ্ট হবে
২. সবুজ রঙের আবির:
কাঁচা সবুজ রঙের আবির চারিদিকে আকাশে বাতাসে মিশে যায় এই দোল পূর্ণিমাতে। সবুজ রঙের আবির তৈরি করতে হেনা পাউডার ব্যবহার করতেই পারেন। এটি ত্বক ও চুলের জন্য খুবই ভালো, এছাড়াও নিম পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে বাড়িতে সবুজ আবির তৈরি করে নিন। বসন্তের এই সময়ে নিম পাতা শরীরের জন্য কতখানি উপকারী, তা আর নাই বা বললাম।
৩. কমলা রঙের আবির:
বড় কমলা রঙের গাঁদা ফুল যাকে গ্রামবাংলায় থাবা গ্যাঁদা বলা হয়। সেই গাঁদা ফুল শুকিয়ে আপনি কমলা রঙের আবির তৈরি করতে পারবেন। কমলা গাঁদা ফুল কিংবা পলাশ ফুল শুকিয়ে গুঁড়ো করে নিন এর সঙ্গে সামান্য ট্যালকম পাউডার মেশালেই কমলা রঙের আবির তৈরি হয়ে যাবে।
৪. হলুদ আবির:
হলুদ আবির, এটা আবার নিশ্চয়ই কঠিন লাগবে না, কেননা রান্নার হলুদ অথবা কাঁচা হলুদ শুকিয়ে সেটা গুঁড়ো করে তা দিয়েও কিন্তু হোলি খেলা যায়। এটা কখনোই ত্বক অথবা চুলের জন্য ক্ষতিকর তো হবেই না, তার সাথে সাথে রূপচর্চা টাও আলতো করে হয়েই যায়।
হলুদ গুঁড়ো এবং ময়দা ১:২ অনুপাতে মিশিয়ে হলুদ রঙের আবির বাড়িতেই বানাতে পারেন। কিংবা কাঁচা হলুদ শুকিয়ে গুঁড়ো করে তৈরি করতে পারেন এই আবির। এছাড়া হলুদ গাঁদা ফুল মিশিয়েও সহজে বানানো যায় এই হলুদ আবির।
দোল পূর্ণিমার দিন রং খেলার সুরক্ষিত উপায়
৫. গোলাপি আবির:
গোলাপি আবির তৈরি করার জন্য রান্নাঘরে থাকা একটি সবজি আপনার অনেক কাজে আসবে। লাল বিট ছোট ছোট করে কেটে তা শুকিয়ে নিন এবং এরপর বানিয়ে ফেলুন গোলাপি রঙের আবির। এছাড়াও গোলাপি রঙের গোলাপ ফুল শুকিয়েও সহজেই এটি বানাতে পারেন। তবে এর জন্য আপনাকে থাকতে হবে সর্বদা প্রাণোচ্ছল।
৬. নীল রঙের আবির:
নীলকন্ঠ ফুল দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার রং একেবারে নজর কাড়বে। নীল রঙের আবির তৈরি করতে আপনি ব্যবহার করতে পারে অপরাজিতা ফুলের গুঁড়ো। অপরাজিতা ফুল খুবই ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে সেগুলি গুড়ো করে আপনি অনায়াসেই তৈরি করতে পারবেন এমন আবির।
এগুলি ছাড়াও ফুড কালার ব্যবহার করেও বিভিন্ন রঙের আবির তৈরি করা যাবে বাড়িতে। ফুড কালার খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, তাই বুঝতেই পারছেন এটি কখনোই ক্ষতিকর হবে না।
এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরী যে, এই সমস্ত আবির যখন ফুলগুলি শুকিয়ে গুঁড়ো করে বানাবেন সেই সময় এর মধ্যে আপনার পছন্দমত সুগন্ধি মেশাতে পারেন।
সেই সুগন্ধি হিসেবে সামান্য আপনার পছন্দের এসেন্সিয়াল অয়েল যোগ করতে পারেন। মিষ্টি গন্ধ থাকার পাশাপাশি এই প্রাকৃতিক আবির রং খেলাতে আপনাকে কোনভাবেই থামাতে পারবে না।
৭. বিভিন্ন রঙের আবির:
ফুড কালার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কমবেশি পাওয়া যায়। কেননা কোন কিছু খাবার তৈরি করতে গেলে এই ফুড কালার বিশেষ একটা মাত্রা যোগ করে। ফুড কালার প্রতিটি বাড়িতে থাকার কারণে এইগুলি ব্যবহার করেও বিভিন্ন রঙের আবির তৈরি করতে পারবেন।
এক্ষেত্রে শুধুমাত্র যে ফুল দিয়ে করতে হবে, বাধ্যতামূলক নয়। কেননা ফুল দিয়ে আবির তৈরি করতে অনেকটা ফুল লাগলেও ফুড কালারে আপনি তার অভাবটা পূরণ করতে পারবেন।
এক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি যে, এর মধ্যে এসেনশিয়াল অয়েল অর্থাৎ সুগন্ধি যোগ করতে পারেন, ফলে আবিরের মধ্যে থেকে একটা সুন্দর গন্ধ আসবে, যা আপনাকে মোহিত করে তুলবে।
রাধা কৃষ্ণের সময় থেকে শুরু করে আজও দোল বাঙালির অন্যতম একটি উৎসব। রঙে রঙে ভরে ওঠে আমাদের চারিপাশটা। রঙের খেলায়, ভালোবাসায়, চারিদিকে চির পরিচিত মানুষগুলো হয়ে ওঠে একেবারে রঙিন। ভেষজ আবিরের নামে বাজারে রয়েছে অনেক ভেজাল। তাই ভেজালের ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো।
সেই কারণে নিজের হাতে তৈরি করা একেবারে প্রাকৃতিক ও অকৃত্রিম আবির দিয়ে মেতে উঠুন দোল খেলায়। সুরক্ষিতভাবে উদযাপন করুন দোল উৎসব, সকলের জন্য রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।