Poush Laxmi Puja 2024: পৌষ সংক্রান্তিতে এই পূজার বিধি ও নিয়ম জানুন

পৌষ লক্ষ্মী পূজা (Poush Lakshmi Puja in Bengali): পৌষ মাস মানেই পৌষ সংক্রান্তি, পিঠেপুলি এবং সকলের ঘরে ঘরে নতুন ধান তোলা, নতুন ধানের গোলা ভর্তি করা। এই সমস্ত কাজ ও উৎসব বিশেষ করে গ্রাম বাংলার মানুষদের কাছে এক পরম উৎসব। সারা বছর ধরে এই দিনটার জন্য, এই মাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন অনেকেই। পল্লীগ্রামের এমন কোন ঘর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নতুন ধান উঠেনি।

বাংলা ক্যালেন্ডার হিসেবে বছরের নবমতম মাস পৌষ মাস, পৌষ মাসকে অনেকে কিন্তু সৌভাগ্যের মাস হিসেবেও অভিহিত করেন। কেননা এই মাসেই যে পৌষ লক্ষ্মী সকলের ঘরে ঘরে পূজা নিতে আসেন।

পৌষ লক্ষ্মী পূজা: পৌষ সংক্রান্তিতে এই পূজার বিধি ও নিয়ম জানুন
পৌষ লক্ষ্মী পূজা: পৌষ সংক্রান্তিতে এই পূজার বিধি ও নিয়ম জানুন

মা লক্ষ্মীর আরাধনা প্রতিটি গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে হয়ে থাকে সারা বছর ধরে। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার থেকে শুরু করে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা তো ধরাই আছে। তবে পৌষ মাসের লক্ষ্মীপূজা এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদে সকলের ঘরে নতুন শস্য ওঠে, তাকে ধন্যবাদ জানাতে এবং তার কৃপা পাওয়ার জন্য পূজা অর্চনা করা হয় প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে। খাদ্যশস্য, ধন-সম্পদের দেবী হলেন মা লক্ষ্মী।

তাই তার পূজা করে এই সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। কোজাগরি লক্ষ্মী পূজার মতো পৌষ মাসে, চৈত্র মাসে অথবা ভাদ্র মাসেও কিন্তু দেবী লক্ষ্মীর বিশেষ পূজা করা হয়। তবে অঞ্চল ভেদাভেদ অনুসারে এক একটি জায়গায় এক একটি নামে এই লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে।

পৌষ লক্ষ্মী পূজার কিছু বিশেষ রীতি:

আশ্বিন কার্তিক মাসে কোজাগরী এবং দীপান্বিতা লক্ষ্মী পূজার পর পর এই বিশেষ করে কৃষি নির্ভর পল্লী বাংলার ঘরে ঘরে পৌষ লক্ষ্মীর আরাধনা হয়। পল্লী বাংলার ঘরে হয় এই পৌষ লক্ষ্মীর আরাধনা আর এই পূজার সময় মাটির সরায় আঁকা পটে যাকে এখানে বলা হয় লক্ষ্মী সরা বলে। নতুন ফসলের অন্ন দিয়ে ভোগ দিয়ে বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে পূজা হয় দেবী পৌষ লক্ষ্মীর।

সাধারণত লক্ষ্মী পূজার মতোই পৌষ লক্ষ্মীর পূজার সময় মূল আয়োজনের ক্ষেত্রে ঘরের মহিলা সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূজার জন্য কোথাও কোথাও ডাকা হয় পুরোহিতকে। কখনো বা বাড়ির মহিলা সদস্যরাই এই পূজা করেন।

বাড়ি ঘর উঠোন সব আগে থেকেই গোবর জলে ধোয়া হয়।ধানের মরাইতে দেওয়া হতো শ্রী চিহ্ন অর্থাৎ ধানের গাদায় কিছুটা জায়গা কাদা দিয়ে সেখানে সুন্দর করে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা হয়। গোয়ালঘর এবং পালিত পশুদের থাকার জায়গাও কিন্তু সুন্দর করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়।

অনেক বাড়িতে চাষের জিনিসেরও পূজা দেওয়া হয় এই দিন। যেমন ধরুন নাঙ্গল, ট্রাক্টর, ধান ঝাড়া মেশিন এবং আরো অন্যান্য যে সমস্ত কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলোরও পূজা করা হয়। কেননা এগুলির মাধ্যমেই তো নতুন শস্য আজ ঘরে উঠেছে, তাই না !

পূজায় দেওয়া হয় নানা রকমের মৌসুমী ফল। কেননা এই সময়টা সম্পূর্ণ শীতকাল, শীতকাল মানে বিভিন্ন রকমের রংবেরঙের সবজি ও ফলমূল মা লক্ষ্মীকে দেওয়া হয়, নতুন চালের পিঠে, পায়েস ও অন্ন ভোগ।

এছাড়া এই বিশেষ শুভদিনে সমস্ত গ্রাম বাংলার মানুষ মেতে ওঠেন খুব আনন্দে, চারিদিকে যেন এক বড় ধরনের উৎসব, সেই কারণেই তো কথায় আছে “কারো পৌষ মাস তো কারো সর্বনাশ,” তাই বোঝাই যায় পৌষ মাস মানে কিন্তু সকল বাঙ্গালীদের কাছে এক ভীষণ আনন্দের এবং উন্নতির একটি মাস।

লক্ষ্মী পূজায় লক্ষ্মী পাঁচালী পাঠ:

পৌষ লক্ষ্মী পূজা সাধারণ লক্ষ্মী পূজার মতই, তবে এর কিছু আলাদা নিয়ম রয়েছে। লক্ষ্মী পূজায় বিশেষ বিষয় হল পাঁচালী পাঠ করা, বাড়ির মহিলা সদস্যরা এই পাঁচালী পাঠ করেন।

নীতিতে অবচলিত থেকে ভক্তি ও বিশ্বাসের অচল থেকে মা লক্ষ্মীর পূজা করলে কিভাবে তার আশীর্বাদ পাওয়া যাবে সেই কথাই কিন্তু বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই ব্রতকথায়।

আউনি বাওনি ও আলপনা:

পৌষ সংক্রান্তিতে যে লক্ষ্মী পূজা হয় তার সাথে গোটা বাড়ি জুড়ে সুন্দর চালের আলপনা, আওনি বাওনি এই সব কিছুর তাৎপর্য রয়েছে প্রচুর। তার সঙ্গে আঁকা হয় চাঁদ, সূর্য আর দাঁড়িপাল্লা।

বাড়ি তে তুলসী মঞ্চের সামনেও আলপনা দেওয়া হয়ে থাকে, সেখানে সিঁদুর এবং চন্দনের ফোটা সহ আরো অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে লক্ষ্মী পূজা সম্পন্ন করে থাকেন অনেক গৃহস্থ বাড়ি।

আওনি বাওনি গুলো তৈরি করে রান্নাঘরে, ভাতের হাঁড়ির পাশে এবং ঘরের চালে ঝুলিয়ে রাখতে হয়, এছাড়া আরও একটি বিশেষ বিষয় সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন না, পৌষ লক্ষ্মী পূজায় কিন্তু ব্যবহার করা হয় হলুদ সর্ষের ফুল

পৌষ সংক্রান্তিতে পৌষ লক্ষ্মীর পূজার পরম্পরা:

বর্তমানে যে সমস্ত নিয়মকানুন গুলি আমরা দেখছি সেগুলো অনেক প্রাচীনকালে পূর্বপুরুষদের দ্বারা প্রথা অনুযায়ী রীতি অনুযায়ী চলে আসছে। বাঙ্গালীদের ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পূজা যেন এক সাধারণ বিষয়, তবে বাঙালী কায়স্থের ঘরে পাতা লক্ষ্মীর নতুন ধানের পূজা। যা বংশ পরম্পরায় মা ঠাকুমারা পেতে ছিলেন সেই পূজা।

একান্নবর্তী পরিবারে সেই পূজা যেন ঘরোয়া পূজা হলেও যেন বিশাল এক অনুষ্ঠান। নিয়ম নীতি নিষ্ঠা মেনে এই পৌষ সংক্রান্তির পুজোর সময় নতুন ধান আনতে হয়। পুজোর সমস্ত জিনিসপত্র ধুয়ে পরিষ্কার করে তবে আবার নতুন করে ব্যবহার করা হয়।

এই পুজো দুবেলাই হয়, নিয়ম মেনে লক্ষ্মীর সাথে দেওয়া হয় নৈবেদ্য আর এই পুজো করলে বংশের একজনকে উপোস করে থাকতেই হয়, সেই দিন সেই ব্যক্তি অন্ন গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে উপোস থেকে ফল বা ময়দা দিয়ে তৈরি কোন খাবার খেতে পারবেন।

পূজার নৈবেদ্য:

লক্ষ্মী দেবীকে সন্তুষ্ট করে ঘরে সারা জীবনের মতো বেঁধে রাখতে কে বা চাইবেন না বলুন। তাই লক্ষ্মী দেবী সন্তুষ্ট হন এমন সব উপকরণ দিয়ে তাকে আরাধনা করা হয়। পূজার উপাদান হিসেবে তিলের খাজা, তিলের পাটালি, নলেন গুড়, নতুন চাল, বিভিন্ন রকমের ফল, এই সমস্ত নৈবেদ্য হিসেবে আয়োজন করা হয়, আর নতুন ফলমূলে মাকে আবরণের প্রাচুর্য রাখা হয়।

সন্ধ্যা আরতি:

লক্ষ্মী পূজা সন্ধ্যের পরে রাতের দিকে যেন আরো বেশি মোহময় হয়ে ওঠে। সন্ধ্যেবেলায় সান্ধ্য প্রদীপে আরতি করে তবে কিন্তু এই পৌষ পার্বণে রান্না শুরু হয়। অনেক জায়গায় বিভিন্ন ভাজার সাথে মাছের টকও কিন্তু থাকে। এই সময় দূরে কোথাও যাত্রা করা একেবারেই অশুভ বলে মনে করা হয় অর্থাৎ কোথাও যদি যাওয়াও হয় তবে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসতে হবে।

তিন দিন তিন রাত এক ভাবে এই অনুষ্ঠানের আনন্দ এবং পিঠে খাওয়া হয় বছরে এক অনন্য স্বাদের পিঠের সাথে উপাচার বাঙালির বিশিষ্টতা দান করে। এই উৎসব বাঙালিয়ানাকে আরো বেশি সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলে।

ধান্য পূর্ণিমা:

নতুন ধান ওঠার উৎসবে পৌষ সংক্রান্তি পালন করে থাকেন সকল বাঙালিরা, এই পূজা সন্ধ্যাবেলায় হয়। প্রথমে অবশ্যই সূর্যের পূজা তারপর প্রথা মেনে নতুন ধানের সাথে এই লক্ষ্মীপূজা করা হয়। তবে নতুন ধানে এই পূজা অনেকটাই পাতা লক্ষ্মীর মত হয়ে থাকে, অনেক জায়গায় ধান পেতে আলপনা সহযোগে বেরি ধানের আবেশে ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীর আহ্বান জানানো হয়।

আর এই লক্ষ্মীপূজা সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য তে এক মেলবন্ধনের উৎসব। এছাড়া সকলের মুখে মুখে শোনা যায় যে এই লক্ষ্মী পূজার দিন বাড়িতে আলপনা দেওয়ার সাথে সাথে খই-নাড়ু সহযোগে লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করলে সংসারে কোনদিন অভাব হয় না।

তুষ তুষলী ব্রত: 

রাঢ় বাংলায় এখনো পৌষ পার্বণে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী নারায়ণের পূজা করে থাকেন কুমারী মেয়েরা, এখানেও কিন্তু বিভিন্ন শস্য দানা মাটির মালসায় দেওয়া হয় আর প্রতি বৃহস্পতিবার তুলসী তলায় সেই মালসা দিয়ে এই হয় পূজা অর্চনা। পূজার শেষে মকর সংক্রান্তির দিন তা ভাসিয়ে বাড়িতে পিঠে পুলি তৈরি করা হয়।

আর এই ব্রত পল্লী বাংলায় তুষ তুষলী ব্রত নামে পরিচিত। গ্রামের অনেক জায়গায় এখনো এই পূজা খুবই সুন্দরভাবে উদযাপন করা হয়। বাড়ির সকলের মঙ্গল কামনায় এই পুজো করে থাকেন কুমারী মেয়েরা।

সেইসঙ্গে চাষাবাদ যাতে ভালো হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হয়, সংসারে কোনরকম অশান্তি যেন না হয়, এমন সব প্রার্থনা করে লক্ষ্মী নারায়ণের কাছে আবেদন করে থাকেন এই সমস্ত কুমারী মেয়েরা।

তবে পৌষ লক্ষ্মীর পূজা করা সাধারণ পূজার মতোই, তার সাথে জড়িত রয়েছে মকর সংক্রান্তির বিশেষ কিছু নিয়ম নীতি। আপনি পুরোহিত ডেকেও পূজা করতে পারেন এবং নিজের ভক্তি নিষ্ঠা এবং সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে যদি নিজেরাই বাড়িতে পূজা অর্চনা করেন তাহলেও কিন্তু এই লক্ষ্মী পূজা করা খুবই সহজ।

সংসারের মঙ্গল কামনায় বাড়ির সকল বিবাহিত মহিলারা এবং কুমারী মেয়েরাও কিন্তু এই পূজায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। তার পাশাপাশি পৌষ পার্বণের আরো অন্যান্য নিয়ম কানুন গুলি মানার সাথে সাথে এই দিনটি বাচ্চা থেকে বড় সকলের কাছে খুবই আনন্দের দিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top