কার্তিক মাস 2023: ১২ মাসের মধ্যে কার্তিক শ্রেষ্ঠ মাস কারণটা জানেন কি?

বাংলা ক্যালেন্ডার বৈশাখ মাসের ১ লা বৈশাখ থেকে শুরু করে চৈত্র মাসের নীল পূজা দিয়ে শেষ হয়। এর মধ্যে  বারো টি মাস রয়েছে। তবে এই বারো মাসের মধ্যে কার্তিক মাসকে সব থেকে শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সনাতন ধর্ম অনুসারে কার্তিক মাসকে হিন্দুদের জন্য একটি সম্ভাবনাময় মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। কার্তিক মাসের শুরুতেই শীতকালের আগমন হয়।

এই কার্তিক মাস দিয়ে অষ্টম মাসটি শুরু হয়, যখন সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করে। এই কার্তিক মাস জুড়ে চলে বিভিন্ন ধরনের ধর্ম অনুষ্ঠান এবং প্রচলিত প্রথা পালন করা হয়। তাছাড়া গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মতে কার্তিক মাস নভেম্বর মাসে পড়ে থাকে সাধারণত।

১২ মাসের মধ্যে কার্তিক শ্রেষ্ঠ মাস কারণটা জানেন কি?
১২ মাসের মধ্যে কার্তিক শ্রেষ্ঠ মাস কারণটা জানেন কি?

এই কার্তিক মাসে বিভিন্ন দেব-দেবীদের আরাধনা থেকে শুরু করে শ্রীমৎ ভাগবত গীতা পাঠ এবং লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা, সত্যনারায়ণ এর পূজা, তুলসী পূজা সবকিছু খুবই নিষ্ঠা ভরে পালন করা হয়।

এই মাসে আবার কার্তিক পূজাও পড়ে, তাই সবদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে কার্তিক মাস সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি শ্রেষ্ঠ মাস, যা কিনা দেবতারা দুই হাত ধরে ভক্তদের শুধুই দান করে যান।

তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, বারো মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস কার্তিক মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে:

দেবাদিদেব মহাদেব অথবা শিবের আরাধনা:

কার্তিক মাস বিষ্ণু ও শিব ভক্তদের অনুকূলে বলে এই সময় বিষ্ণু ও শিবের মন্দিরে হাজার হাজার ভক্তদের সমাগম ঘটে, কার্তিক মাসের কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের অনেক মানুষ কার্তিক সোমবার ব্রত পালন করে থাকেন। এই মাসে পূর্ণিমাতে কার্তিক নক্ষত্রটি চাঁদের সহচর্যে থাকে তাই এই মাসের নাম কার্তিক মাস হয়েছে।

মহাদেব অথবা শিবের আরেক নাম সোম বা সোমেশ্বর, কার্তিক সোমবার ব্রত প্রভু সোমেশ্বর কে সন্তুষ্ট করার জন্য পালন করা হয়। কার্তিক মাসের প্রত্যেকটি সোমবার শিবের আরাধনা এবং তার আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত সময়। হিন্দু ধর্ম মতে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, কার্তিক মাসের শিব এবং বিষ্ণুর আরাধনা করলে মানুষ তাদের সমস্ত পাপ থেকে উদ্ধার হতে পারবেন।

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে জেনে না জেনে অনেক পাপ কাজে লিপ্ত হতে হয় বহু মানুষের। তবে সেই পাপ কাজ থেকে নিজেকে আরও বেশি সংযত রাখার জন্য পূজা অর্চনার মধ্যে দিয়ে পাপ মোচন করা হয়। তার পরিবর্তে দেবতাদের আশীর্বাদ লাভের জন্য কত কিছুই না করা হয়ে থাকে।

কার্তিক মাসের গুরুত্ব:

১২ মাসের মধ্যে প্রতিটি মাসের কোন না কোন তাৎপর্য ও গুরুত্ব বজায় থাকে। তবে বারো মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস কার্তিক মাসের গুরুত্ব অনেকখানি। কেন এই কার্তিক মাসকে শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সে সম্পর্কে জানতে নিশ্চয় ইচ্ছা করছে, তাই তো !

তো চলুন তাহলে এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে জানা যাক, যে কারণে কার্তিক মাসকে শ্রেষ্ঠ মাস বলা হয়:

#১) পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় বিষ্ণু ভগবান অসাদ্ধ শুদ্ধ একাদশীতে অবসর নেন এবং কার্তিক শুদ্ধ একাদশীতে জাগ্রত হন।

#২) পুরান মতে জানা যায় যে, শিব কার্তিক পূর্ণিমাতে ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন এবং বিশ্ব সংসারকে রক্ষা করেছিলেন, তাই তিনি ত্রিপুরহরি নামে পরিচিত। আর এই কারণে কার্তিক মাসের গুরুত্ব অনেকখানি।

#৩) যে সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা দীক্ষা নিতে চান তারা কিন্তু এই কার্তিক মাসকেই বেছে থাকেন। কার্তিক মাসে আয়াপ্পা দীক্ষা নিতে শুরু করেন অনেকেই, যা কিনা মকর সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত চলতে থাকে।

#৪) সারা বছরের মধ্যে শুধুমাত্র কার্তিক মাসেই কিন্তু গঙ্গা নদী প্রতিটি জলাশয়, নদী, খাল এবং বিলে প্রবেশ করে থাকে তাদেরকে পবিত্র এবং পরিপূর্ণ করে তুলতে।

#৫) কার্তিক মাসে নতুন শস্য তে খেত ভরে যায় এবং কিছুদিন পরেই বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে নতুন শস্য তোলা হয়, যা কিনা নবান্ন উৎসব পালন করার জন্য শুভ সূচনা মাত্র।

কার্তিক মাসের বিভিন্ন প্রথা:

প্রথা, রীতি- নীতি মেনে সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতিটি দিন কেটে যায়। ছোটখাটো এমন কিছু প্রথা রয়েছে যেগুলো অনেক প্রাচীনকাল আগে থেকে মেনে আসছেন  পূর্বপুরুষরা। তবে এই কার্তিক মাসে এমন অনেক প্রথা রয়েছে যেগুলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে বাড়িতে আসে সমৃদ্ধি, সংসারে আসে সুখ, শান্তি আর ধন-সম্পদ বৃদ্ধি হয়েই থাকে।

তো চলুন তাহলে কার্তিক মাসের কিছু প্রথা সম্পর্কে জানা যাক:

#১) প্রথমেই আপনাকে ঊষা লগ্নে অর্থাৎ ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে জেগে উঠতে হবে, বলতে গেলে একেবারে ভোরবেলা।

#২) কার্তিক মাসের গুরুত্ব বুঝতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম অনুষ্ঠান অনুসরণ করা আপনার অবশ্যই অবশ্যই প্রয়োজন।

#৩) তারপর ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে পবিত্র নদীর জলে স্নান করতে হবে। যদি গঙ্গা স্নান অথবা কোন নদীতে স্নান করা সম্ভব না হয়ে ওঠে, তাহলে বাড়িতে থাকা গঙ্গাজল স্নানের জলে কিছুটা মিশিয়ে তা দিয়েও আপনি পুণ্য স্নান সম্পন্ন করতে পারবেন।

#৪) নিজের বাড়িতেই নৈবেদ্যের আয়োজন করুন এবং প্রতি সোমবার মন্দিরে পূজা-অর্চনা করতে যান। এর পাশাপাশি শিবের আরাধনা করতেও ভুলবেন না।

#৫) সারা মাস জুড়ে প্রতিদিন কার্তিক পুরানামের প্রতিটি অধ্যায় পড়তে পারেন।

#৬) প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যার সময় পবিত্র প্রদীপ জ্বালান, সেটা যদি ঘি এর প্রদীপ হয় তাহলে তো খুবই শুভ আপনার সংসারের মঙ্গল কামনায়।

#৭) সম্পূর্ণ কার্তিক মাস জুড়ে নিরামিষ খাবার খাওয়া অনেকখানি পূণ্যের কাজ। তার সাথে সমগ্র দিনের মধ্যে শুধুমাত্র একবার যদি আহার গ্রহণ করেন সেক্ষেত্রে আরো শুভফল লাভ করতে পারবেন।

#৮) গরিব দুঃখীদের সেবা করুন, তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দান করে তাদেরকে সহযোগিতা করুন। দান শুধুমাত্র টাকা পয়সা দিয়ে যে করতে হবে এমনটা কিন্তু নয়, গরিব মানুষদের কোন জিনিসটা প্রয়োজন সেটা ও খেয়াল করতে পারেন, যেহেতু এটা শীতের আগমন তাই গরম জামা কাপড় অথবা শীত বস্ত্র এবং খাবার দাবার দিয়েও আপনি তাদের সাহায্য করতে পারেন।

#৯) প্রতিদিন ইষ্ট নাম জপ করুন। ঈশ্বর আরাধনায় মন্ত্র পাঠ, মালা জপ করা খুবই পূণ্যের কাজ।

#১০) কার্তিক পূর্ণিমায় শিব মন্দিরে প্রদীপ জ্বালানো শুভ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই কার্তিক পূর্ণিমা এবং কার্তিক মাসের প্রতি সোমবার শিব মন্দিরে গিয়ে ঘি এর প্রদীপ জ্বালাতে ভুলবেন না।

#১১) আমলকি গাছের পূজা করতে পারেন খুবই ভক্তির সাথে, পাপের থেকে পরিত্রাণ পেতে আমলকি গাছের তলায় নৈবেদ্য নিবেদন করুন এবং পূজা করুন।

#১২) কার্তিক মাসের শেষ দিন পলি সরগম অমাবস্যা দিবস হিসেবে পরিচিত খুবই আশাপ্রদ হয় এই দিনটি।

#১৩) এই দিনে অর্থাৎ কার্তিক মাসের শেষ দিনে ৩১ টি সলতে দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে কলা গাছের ভেলায় নদীতে ভাসিয়ে দিতে হয়। এর পাশাপাশি সম্পূর্ণ কার্তিক মাস ধরে তুলসী পূজা এবং মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।

কার্তিক মাসের তাৎপর্য:

বলতে গেলে অনেক উৎসব একসাথে সংগঠিত হয় এই কার্তিক মাসে, কার্তিক মাস মানে চারিদিকে শীতের আমেজ, গাছের পাতা ঝরা শুরু। অসাধারণ তাৎপর্য আছে কার্তিক মাসের। সেই কারণে সমস্ত মাস জুড়ে বিভিন্ন রকমের প্রথা ও নিয়ম গুলি মেনে চলা হয়।

আপনি যদি কার্তিক মাসের ধর্ম অনুষ্ঠান অনুসরণ করেন পুরাতন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী আপনার জীবন সুশৃংখল হবে এবং আপনি সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেকখানি অবগত হতে পারবেন।

নদী অথবা দীঘিতে ভোরের আগে স্নান, কার্তিক মাসে ধর্ম অনুষ্ঠানের মধ্যে খুবই সুন্দরভাবে অন্তর্ভুক্ত। আর এটা আপনাকে অবশ্যই পালন করতে হবে। যার ফলে শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি আপনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপ্ত করতে পারবেন। এই উপলক্ষে মানুষের ভোরে ঘুম থেকে ওঠার একটা অভ্যাসও রপ্ত হয়ে যায়।

কথায় আছে কোন কাজ যদি একটানা ২১ দিন করা যায়, তাহলে সেই কাজ যতই কঠিন হোক না কেন, সেটা কিন্তু একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। আপনি তখন আনন্দের সাথে সেই কাজটি করতে পারবেন। তাহলে এখানে তো একটা মাস অর্থাৎ ৩০ দিনই হাতে পাচ্ছেন, এই একটা মাসের মধ্যে আপনি সুন্দরভাবে ভরে ঘুম থেকে ওঠা এবং সুশৃংখল জীবন যাপন করার সু- অভ্যাস তৈরি করতে পারবেন।

অনেকেরই প্রতি দিন ঠান্ডা জলে স্নান করে থাকেন, যা আপনাকে শীতের মাসগুলোতে ঠান্ডার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে। তখন আর অতিরিক্ত ঠান্ডাতেও ঠান্ডা জলে স্নান করতে ভয় লাগবে না। এই ধর্ম অনুষ্ঠান আপনাকে জলের গুনের সাথে সাথে দূষণ সম্পর্কেও অবগত করে।

এছাড়াও দান করা খুবই পূণ্যের কাজ, সেগুলি সম্পর্কেও আপনি ভীষণভাবে উৎসাহিত হতে পারবেন এবং আপনার মধ্যে দরিদ্র মানুষের প্রতি সহানুভূতি, সহিষ্ণুতা এবং তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলি দান করে তাদের জীবনকে সচ্ছল করে তোলার একটা সুন্দর মানসিকতা তৈরি হবে।

আর তাই সব দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে কার্তিক মাস একটা সাধারণ মানুষের জীবনে অনেক খানি পরিবর্তন এবং সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করার উৎসাহ জুগিয়ে থাকে।

Leave a Comment