প্রতিটি পূজা পার্বণ বিভিন্ন রীতি-নীতির উপরে নির্ভর করে, তেমনি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো (Saraswati Puja) সরস্বতী পূজার আগে কুল খেতে নেই, এ নিয়ে রয়েছে অনেক লোককথা, অনেক বিধি নিষেধ, অনেক ভয় দেখানো কথা, ছোট ছোট বাচ্চাদের এই কুল খাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য অনেক কিছুই করতে হত বাবা-মা দের।
অনেক কথাই বলা হত, “সরস্বতী পূজার আগে কখনোই কুল খেতে নেই, না হলে দেবী কিন্তু অসন্তুষ্ট হবেন, বিদ্যা, বুদ্ধি দেবেন না, বোকা হয়ে থাকবে আর একেবারেই পড়াশোনা ভালো হবে না,” কোন বাচ্চাই চাইবে না যে সে পড়াশোনায় খারাপ হোক, তাই ভয়ে আর দেবী সরস্বতী যেন অসন্তুষ্ট না হন, সেই কারণে কুল খাওয়া থেকে বিরত থাকতো প্রতিটি বাচ্চা। এমন কি বড় হয়েও অনেকেই এই নিয়ম মেনে থাকেন।
মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ঘরে ঘরে চলবে বাগদেবীর আরাধনা, উপোস করে অঞ্জলিতে ব্যস্ত থাকবে সমস্ত পড়ুয়া থেকে অনেকেই, আর তারপরেই চলবে কুল খাওয়া, কেননা অনেক দিনের অপেক্ষার অবসান হবে যে, আজ যে হাতে পাওয়া গিয়েছে সেই পছন্দের জিনিসটি।
ছোট থেকে আমরা সবাই শুনে আসছি পুজোর আগে ফুল খেতে নেই। বাড়ির বড়রা ছোটদের কুল খাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য এটাও বলেছেন যে, “সরস্বতী ঠাকুর রাগ করবেন, তিনি রাগ করলে পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না, ভালো ফল করতে পারবে না, কিন্তু কেন এই নিয়ম সে সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন না।
কৃষি প্রধান আমাদের এই দেশ যেখানে দেব দেবীদের পূজাতে বিভিন্ন ধরনের ফসল, ফল, ফুল অর্পণ করা হয়। আর শীতকালে যেহেতু এই সরস্বতী পূজা হয়ে থাকে, তাই এই সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফল হলো কুল, আর সরস্বতী পূজা তো বসন্ত পঞ্চমীর সময়ই হয়, তাই এই সময় কুল খুব ভালো হয়। আর প্রথমে এই ফলটিও দেবতাকে উৎসর্গ করা হয় আর এটাই প্রসাদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক কেন সরস্বতী পূজার আগে কুল খেতে নেই ?
পৌরাণিক কাহিনী:
প্রতিটি নিয়মের পেছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী, ইতিহাস আরও অনেক কিছু। যা শুনতে খুবই ভালো লাগে। তেমনি এই বিষয়টার পেছনে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনী।
শাস্ত্র অনুসারে জানা যায় সরস্বতী দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব বদ্রিকা আশ্রমে তপস্যা শুরু করেছিলেন, সেই তপস্যা শুরুর আগে তার তপস্যার জায়গার কাছাকাছি একটি কূল এর বীজ রেখে দিয়ে দেবী একটি শর্ত দেন, “যতদিন না এই কুলের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা গাছ থেকে বড় গাছের রূপান্তরিত হয়ে নতুন কুল হবে, সেই কুল পেকে গিয়ে ব্যাসদেবের মাথায় পড়বে, ততদিন পর্যন্ত দেবীর তপস্যা করতে হবে”।
তারপরেই দেবী সরস্বতী সন্তুষ্ট হবেন, যেমন কথা তেমন কাজ, ব্যাসদেব সেই শর্ত মেনে নিয়ে তপস্যা শুরু করলেন, আর সেদিন নতুন কুল তার মাথায় পড়লে তিনি বুঝতে পারেন যে সরস্বতী দেবী তার ওপরে সন্তুষ্ট হয়েছেন, সেদিন টি ছিল পঞ্চমী। সেই দিন সরস্বতী কে কুল নিবেদন করে ব্যাসদেব ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেছিলেন।
আর এই নিয়ম মেনেই সরস্বতী পুজোর আগে কোন ভক্ত, পড়ুয়া কুল খান না। শ্রী পঞ্চমীর দিন সরস্বতী দেবীকে কুল নিবেদন করার পরেই কুল খাওয়া হয়। কিন্তু শাস্ত্রের নিয়ম তো আর ছোট বাচ্চারা কখনোই বুঝবে না, তাই না !
তাই বাড়ির বড়রা তাদের এই বলে ভয় দেখান যে সরস্বতী পুজোর আগে ফুল খেলে পরীক্ষায় পাশ করা যায় না, আর এই ভয়েতেই প্রতিটি বাচ্চা পড়ুয়া সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া থেকে বিরত থাকে। আর এই বিশ্বাস মনের মধ্যে এতটাই গেঁথে যায় যে, বড় হয়েও পূজার আগে কুল খেতে একেবারেই মন চায় না।
স্বাস্থ্যগত দিক:
প্রতিটি পূজা পার্বণের নিয়ম অনুযায়ী সেগুলি আমাদের শরীরে বিশেষ উপকারে আসে, সেটা উপবাস হোক, ব্রত হোক অথবা কোন নিয়ম কানুন। তেমনি সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া ঠিক নয়, এমনটা যেমন নিয়ম রয়েছে তেমনি স্বাস্থ্যের দিক থেকে দেখলেও এটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
এই সময় শীতকাল আর বসন্ত কালের মাঝামাঝি চলে, তাই বিভিন্ন রকমের রোগ দেখা দেয়, চারিদিকে সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটের সমস্যা ঘরে ঘরে তো লেগেই রয়েছে।
বিশেষ করে ছোট ছোট বাচ্চাদের তো কাবু করে দেয়। তাছাড়া এই সময়ে কুল খুব একটা পাকে না কাঁচা থাকে, যেটা খেলে কাশি হওয়া, পেটের সমস্যা হওয়ার পাশাপাশি শরীরের আরও অন্যান্য ক্ষতি সাধন করে। সেই দিক থেকে দেখলে এই নিয়মটি সকলের জন্য খুবই ভালো।
এছাড়া কাঁচা কুল খুবই মারাত্মক রকমের টক স্বাদের হয়, যা দাঁত কে এক প্রকার কষ্ট দেয় এবং অন্যান্য খাবার খাওয়ার সময় ভীষণভাবে বিরক্ত করে। সেই সব দিক থেকে বিচার করে বাড়ির বড়রা ছোট ছোট বাচ্চাদের এই সময় কুল খেতে বারণ করেন আর শাস্ত্রে তো নিয়ম রয়েছেই। দুই দিক বজায় থাকলো, কি বলেন !
যাই হোক না কেন, পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এই ঘটনা সবাই না জানলেও সরস্বতী পূজার আগে যে কূল খেতে নেই সেটা আজও সকলেই মানেন। যতই আধুনিকতার ছোঁয়া আসুক না কেন, তবুও এই বিষয়টা সকলের মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে পূজার আগে কুল ছুঁয়ে দেখতে গেলেও যেন মনের মধ্যে একটা কিন্তু ভাব চলে আসে।
ব্যাসদেব যেমন তপস্যায় দেবী সরস্বতীকে সন্তুষ্ট করার জন্য এমনটা করেছিলেন, সে ক্ষেত্রে সমস্ত পড়ুয়া এবং তার ভক্তরাও তো কম সাধনা করেন না বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞানের জন্য, তাই এই নিয়ম পালন করাটা তাদের জন্যও প্রযোজ্য, তাই না !