Charak Puja 2024: চড়ক পূজা ও গাজন সম্পর্কে এই অজানা তথ্য আপনি এখনো জানেন না

সারা বছর ধরে বাঙালির উৎসবের কোন শেষ নেই, প্রতিটি মুহূর্ত যেন শুভ রীতি, প্রতিটি দিন যেন উৎসবের দিন। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আগে বাংলার শেষ উৎসব গাজন উৎসব অথবা চড়ক পুজো। এই উৎসবটি শিব, নীল, মনসা ও ধর্ম ঠাকুরের পূজা কে কেন্দ্র করে পালিত হয় গ্রাম বাংলায়। বিভিন্ন জায়গায় এই উৎসব বিভিন্ন নামে পরিচিত।

যেমন ধরুন মালদহে গাজনের নাম গম্ভীরা আর জলপাইগুড়িতে গমিরা। টানা এক মাস ধরে সন্ন্যাসদের মতো জীবন যাপন করে সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে প্রতিটি বাড়ি থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করে সন্ন্যাসীরা শিবের গাজন উৎসব পালন করে থাকেন।

চড়ক পূজা ও গাজন সম্পর্কে এই অজানা তথ্য আপনি এখনো জানেন না
চড়ক পূজা ও গাজন সম্পর্কে এই অজানা তথ্য আপনি এখনো জানেন না

অনেকের অনেক মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য এই উৎসবে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করেন। চৈত্র মাসের চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিতে চড়ক পূজোর সাথে সাথেই এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। গাজন উৎসব স্বাধারণত তিন দিন ধরে চলে, এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো গাজন মেলা

গাজন উৎসবের নামকরণ:

প্রতিটি উৎসবের নামকরণ কোন না কোন কারণ বা ইতিহাস অনুসারে এসেছে, তেমনি বাংলাতে গাজন শব্দটি গর্জন শব্দ থেকে এসেছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা হুঙ্কার দেন এবং প্রচন্ড গর্জন করেন বলে এই উৎসবের নামকরণ এইভাবে হয়েছে।

এছাড়া আরো অন্যান্য মত অনুসারে এটাও বলা হয় যে, গা শব্দের অর্থ গ্রাম এবং জন শব্দের অর্থ জনসাধারণ, জনসাধারণের জন্য নিবেদিত একটি উৎসব, সেই কারণে এই উৎসবের নাম গাজন।

আবার অন্য দিক থেকে দেখলে দেখা যায় যে, ধর্মমঙ্গল কাব্যে রানী রঞ্জাবতীকে দেখা গেছে যে, তিনি নিজের ধর্মকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে গাজন উৎসব পালন করতেন।

লোকোমুখে এই কথাটিও শোনা যায় যে, গাজন উৎসবের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবও রয়েছে কিছুটা। চৈত্র মাসে যদি ৩০ দিন বেতের লাঠি নিয়ে শিবের ব্রত পালন করে নাচ করা যায় তাহলে নাকি শিব লোকের প্রাপ্তি ঘটে বলে বিশ্বাস করেন অনেকেই।

লোকোবিশ্বাস অনুযায়ী গাজন উৎসবের এই দিনটি তে দেবী হরকালীর সাথে শিবের বিবাহ হয়েছিল, আর সেই বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বর যাত্রী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আবার অপরদিকে ধর্ম ঠাকুরের গাজন হল ধর্ম ঠাকুর এবং বাঁকুড়া জেলার প্রসিদ্ধ দেবী কামিনী কামাখ্যা মুক্তির বিবাহ উৎসব।

ব্রিটিশরা বন্ধ করেছিল চড়ক পুজার প্রথা জানুন চড়কের ইতিহাস

গাজন উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়:

অন্যান্য উৎসবের মত গাজন উৎসব যে কোন নির্দিষ্ট সময়ে উদযাপিত হয়। যেমন ধরুন ধর্মের গাজন মূলত বৈশাখ মাসে, জৈষ্ঠ মাসে এবং আষাঢ় মাসে পালন করা হয়। আর চৈত্র মাস ছাড়া যদি বছরের অন্য কোন সময় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে তাকে হুজুগে গাজনও বলা হয়ে থাকে।

গাজন উৎসব উদযাপন: 

আজও গ্রামবাংলায় বিভিন্ন জায়গায় খুবই ধুমধাম ভাবে এই উৎসব পালন করা হয়। দূর দূরান্তর থেকে মানুষজন ছুটে যান সেই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করার জন্য।

শহরের এই ভিড় করা জনবহুল এলাকা ছেড়ে আজও দূর দুরান্তরের কোন গ্রামে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এই উৎসব উদযাপনের চিত্র চোখে পড়ে পরিষ্কার ভাবে। গাজন হল মিলনের উৎসব, এই উৎসবে বিভিন্ন ধর্মের এবং জাতির মানুষ সামিল হতে পারেন।

এই পূজার একটি  বিশেষত্ব হলো সারা বছর ধরে ব্রাহ্মণরা যে শিবকে আগলে রাখেন, গাজনের সেই দিনগুলিতে ভগবান শিব সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষের হাতে পুজো গ্রহণ করে থাকেন। আর সেখানেই নেই কোন রকম ভেদাভেদ, জাত বা কুলের সীমা, উচ্চ বর্ণের অবজ্ঞা অথবা অবহেলা নেই।

গাজনের এই কদিন সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী। আর এখানেই লক্ষ্য করা হয়েছে শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। আর সেই কারণেই বলা হয় যে, গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা।

গাজনের পরবর্তী দিন:

গাজন উৎসবের পরের দিন সকল মায়েরা তাঁদের সন্তানের শুভকামনা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তা করে নীলব্রত পালন করেন। পূজোর রীতি মেনে গাজনের সন্ন্যাসীদের ফল সামান্য অর্থ দান করে থাকেন তারা। এই উৎসবের আরো অন্যান্য রীতিগুলিও খুবই নিষ্ঠার সাথে পালন করে থাকেন গ্রাম অঞ্চলের মানুষজন।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হওয়া গাজন উৎসব:

চৈত্র মাসে চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন উৎসব সাধারণত শৈব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মানা হলেও বর্ধমানের মন্তেশ্বর গ্রামে প্রায় ৪০০ বছর ধরে গাজন উৎসবে মা কালীর আরাধনা করা হয়ে থাকে। এই এলাকায় আরেকটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হলো যে এখানে মানুষই কালী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন অনেকদিন আগে থেকে।

এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই উৎসবে এখানকার শিবলিঙ্গগুলি বেশিরভাগই বৌদ্ধ প্রভাবিত। পাল যুগের জেলাটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মের পিঠস্থান।

গাজন উৎসবের পাঁচদিন নবদ্বীপের সকল জনগণ মেতে ওঠেন এই উৎসব আনন্দে। এই জেলাতে ফুল, ফল, নীল ও চড়ক, সাত গাজন এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে পালিত হয় গাজন উৎসব।

এছাড়াও বাঁকুড়া জেলায় বেলিয়াতোড়ে ধর্মরাজ ঠাকুরের গাজন উৎসবে তিনটি প্রমাণ সাইজের কাঠের ঘোড়ার উপরে মহামানস স্বরূপনারায়ণ এবং ধর্মরাজ যা কিনা যথাক্রমে বোদ্ধ সংঘ ও ধর্মকে চড়ানো হয়।

তার পাশাপাশি অসংখ্য ভক্ত সন্ন্যাসী ও মাথায় জ্বলন্ত ধুনো পাত্র বহন করে নিয়ে যায়। আর ব্রতচারিনী দলের একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এই উৎসবটি পালিত হয় খুবই আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে।

এছাড়া এই উৎসবটি দেবাদীদেব মহাদেবকে উৎসর্গ করা হয়। সেই কারণে চৈত্র সংক্রান্তির দিন হুগলি জেলার তারকেশ্বরে তারকনাথ শিব, পূর্ব বর্ধমান জেলার ঈশানেশ্বর শিব, বাঁকুড়া জেলার এক্তেশ্বর শিব আর বাংলাদেশের ফরিদপুরের কোটালীপাড়ার বুনো ঠাকুর শিবের গাজন খুবই খ্যাতি অর্জন করেছে।

আজও এই সমস্ত জায়গায় চড়ক উৎসবের গাজন উৎসবে খুবই সুন্দরভাবে উৎসবের আয়োজন করা হয়। আর দূর-দূরান্তর থেকে সকলের আগমন ঘটে।

এছাড়াও জৈষ্ঠ্য মাসের দশহরাতে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের অযোধ্যা গ্রামে মনসার গাজন আর আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বাঁকুড়ায় বেলিয়াতোড় এর ধর্মরাজ ঠাকুরের গাজন ও খুবই প্রসিদ্ধ।

চড়ক অথবা ঝাঁপ চড়ক:

চৈত্র মাসের শেষ দিনটিতে এই চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দুই তিন দিন পর্যন্ত চলে এই উৎসবের রেস। বলা যেতে পারে যে এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবেরই একটি অনন্য অঙ্গ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। যাকে চড়ক সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

এই উৎসবে বাঁশের উঁচু মাচা থেকে নিচে জালের উপরে ঝাঁপ দেওয়া হয়। সেই জালের উপরে ত্রিশূল কলা গাছের বেড়ের মধ্যে পুঁতে রাখা হয়। তার উপরেই বুক পেতে ঝাঁপ দিতে হয়। যা চড়কের ঝাঁপ নামে পরিচিত বিভিন্ন জায়গায়।

চরক পূজার ইতিহাস:

চড়ক পূজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে পঞ্চদশ- ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দনন্দের বর্ষাক্রিয়া কৌমুদি ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বে। এছাড়াও পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে পৌরাণিক যুগে এই উৎসব খুবই প্রচলিত ছিল।

উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যে এই অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব একটা প্রাচীন নয়। তবে কথিত আছে যে ১৪৮৫ সালে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে একজন রাজা এই পূজার প্রচলন করেন।

১৮৬৩ সাল থেকে ১৮৬৫ সালের মধ্যে ছোটলাট বিডন এই ভয়ংকর প্রথা রোধ করেছিলেন। এছাড়াও নারী পুরুষ সকলেই শিব পার্বতী সাজে সুসজ্জিত হয়ে হাতে ভিক্ষা পাত্র নিয়ে বের হতেন। সারাদিন ঘোরাঘুরি করার পর তাদের অল্প বিস্তার কিছু প্রাপ্তি হতো। সন্ধ্যা বেলায় তারা সেই ভিক্ষার অন্ন রান্না করে খেতেন।

কোথাও কোথাও এটাও বলা হয়েছে যে, এই সময় ঋণে জর্জরিত কৃষকদের ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হলে চৈত্রের শেষ দিনটিতে বড়শিতে বেঁধে চড়কে ঘোরানো হতো, যা ১৮৯০ সাল পর্যন্ত সকল জায়গায় বিদ্যমান ছিল।

চড়ক পূজার প্রথা:

বলা যেতে পারে যে চড়ক পূজা গাজনেরই রকম ফের। পুজোর উদ্যোক্তা, ভক্তগণ ও সন্ন্যাসীরা চড়ক পূজার কিছুদিন আগে থেকে কঠোর ব্রত ও সংযম পালন করে থাকতেন। একজনকে হনুমানের মত লম্বা লেজ দিয়ে সাজানো হয়, আর তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল।

১) বাবর সন্ন্যাস:

পুজোর আরো কয়েকটি নিয়ম রীতির মধ্যে একটি হলো এই যে, সন্ন্যাসীরা মহাসমারোহে আম গাছ থেকে একাধিক ফল সমেত একটি শাখা ভেঙে আনেন। যার নাম বাবর সন্ন্যাস হিসেবে প্রসিদ্ধ।

২) ঝাঁপ, কাঁটা ঝাঁপ, ঝুল ঝাঁপ:

পূজার দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ কিছু ফুল, ফল নিয়ে বাদ্য সহকারে শিব ঠাকুরের প্রণাম করেন। এছাড়া দেবতার প্রতি তাদের অবিচল ভক্তি ও নিষ্ঠা দেখানোর জন্য তারা ধারালো বটি, গাছের কাঁটার উপর ঝাঁপ দেন অথবা পা দুটি উপরে মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলে থাকেন। আর এই নিয়মগুলি ঝাঁপ, কাটা ঝাঁপ, ঝুল ঝাঁপ, নামে পরিচিত সকলের কাছে।

৩) বাণ সন্ন্যাস:

এছাড়া নিজেকে আরও বেশি অধিক পরিমাণে দৈহিক যন্ত্রণা ও নির্যাতন দেওয়ার জন্য তার পাশাপাশি শিবের আশীর্বাদ পেতে আড়াই থেকে চার পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি লৌহ শলাকা জিভে বিদ্ধ করে রেখে সন্ধ্যার আগে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলে দেয় যার নাম বাণ সন্ন্যাস।

৪) বেত্র সন্ন্যাস:

এর পাশাপাশি নিজেদের পিঠের দুদিকে চামড়া ভেদ করে একটি সরু বেদ প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় যার নাম হল বেত্র সন্ন্যাস

৫) বড়শি সন্ন্যাস: 

আরো একটি বিষয় হলো চড়ক গাছটির চড়ক তলায় পুঁতে দেওয়ার পর তার মাথায় আরো একটি কাঠের খন্ড মধ্যভাগে ছিদ্র করে স্থাপন করা হয়। এর এক প্রান্তে ঝোলানো হয় দড়িতে একজন সন্ন্যাসীকে কোমরে গামছা অথবা কাপড় বেঁধে, তারপর অপরদিকে কাঠের টুকরোটি চক্রাকারে চরকির মতো ঘোরানো হয়, এই প্রক্রিয়াটির নাম বড়শি সন্ন্যাস।

এই সমস্ত কঠিন কার্যক্রম, রীতি, প্রথা গুলি এতটাই ভয়ঙ্কর হওয়া সত্বেও গ্রাম বাংলার মানুষরা খুবই নিষ্ঠার সাথে পালন করে থাকেন ভগবান শিবের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য।

⭐ তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে গিয়েছে অনেক কিছুই। উন্নতি ঘটেছে প্রযুক্তির, কিন্তু সময়ের সাথে যতই আধুনিক হয়ে যাক না সমাজ, তবুও কিন্তু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে প্রাচীন প্রথা গুলি আজও সকলে ভক্তির সাথে পালন করেন চৈত্র সংক্রান্তি তে। পুরনো সেই রীতি-নীতি, প্রথা আজও মানুষ ভুলতে পারিনি।

যতই উন্নত হোক সমাজ এই উন্নত সমাজে পুরনো সেই প্রথা আজও সকলে নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছেন। তাই তো আজও গ্রাম বাংলায় গাজন মেলা, চরক পূজা খুবই ধুমধাম ভাবে পালিত হয়, তাদের নিজেদের মতো করে প্রাচীন প্রথা মেনে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top