সরস্বতী পূজা: জীবনে অর্থের পাশাপাশি জ্ঞান, বুদ্ধি, বিদ্যা, শিল্প-কলা সব কিছুরই প্রয়োজন পড়ে। যেগুলি না হলে জীবনে আগে এগোনোই যায় না। আর এই সব কিছুর দেবী হলেন দেবী সরস্বতী। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই এই সব কিছুই নিজের করে রাখা যায়। আর উন্নতি করা যায় জীবনে। ঘরে ঘরে চলে দেবীর আরাধনা, এই আশীর্বাদ পাওয়ার আশায়।
মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা হয়ে থাকে প্রতিটি ঘরে ঘরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং পূজা মন্ডপে। সারাদিন উপোস থেকে হলুদ রঙের পোশাক পরে দেবীকে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকেন সকল পড়ুয়ারা, তার সাথে সাথে এসে পড়ুয়াদের বাবা মায়েরাও এই পূজাতে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
সরস্বতী পূজার জন্য তোড়জোড় চলে বেশ কিছুদিন আগে থেকে। প্রতিমা আনা, প্রতিমা যেখানে রাখা হবে সেখানে আলপনা দেওয়া, সুন্দর করে সাজানো, সবকিছু মিলিয়ে একটা উৎসব উৎসব আমেজ এই আমেজ কখনোই ভোলার নয়।
দেবী সরস্বতী কে সন্তুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন রকমের ফল, ফুল, নৈবেদ্য অর্পণ করার পাশাপাশি এমন অনেক নিয়ম রয়েছে যেগুলি পালন করলে তিনি সহজেই সকলের উপরে সন্তুষ্ট হন। ভক্তরা সবসময় চেষ্টা করেন দেবী সরস্বতীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য, না হলে যে বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান পাওয়া যাবে না।
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, দেবী সরস্বতীকে সন্তুষ্ট করতে আপনি কোন কাজ গুলি করতে পারেন যা কিনা খুবই সহজ:
১) সুন্দর সাজসজ্জা, মনোরম পরিবেশ:
দেবী সরস্বতী শুভ্র বর্ণা এবং সুন্দর আর সাধারণ সাজে সুসজ্জিতা, তিনি এতটাই সাধারণ সাজ সজ্জা আর ছিমছম পরিবেশ পছন্দ করেন তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর সৌখিন পরিবেশ পছন্দ করেন।
তাই পূজার নাম করে অতিরিক্ত সাজসজ্জা আর চারিদিকটা জমাট বাধা পরিবেশ একেবারেই তৈরি করবেন না। তিনি খুবই মনোরম পরিবেশ আর সুন্দর করে সাজানো জায়গা পছন্দ করেন, যেখানে প্রতিমা রাখবেন সেই জায়গাটি যেন খুবই সুন্দর হয়, তাহলেই তিনি সন্তুষ্ট।
২) তেল ও ঘি এর প্রদীপ:
পূজায় প্রদীপ, ধুপ খুবই প্রয়োজনীয়। তাই সরস্বতী পূজার সময় তেলের প্রদীপের সঙ্গে সঙ্গে ঘি এর প্রদীপ জ্বালাতে একেবারেই ভুলবেন না। জ্বলন্ত প্রদীপ তিনি খুবই পছন্দ করেন সেই কারণে পূজার জায়গায় প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে পারেন সব সময়।
৩) পছন্দের ফুল অর্পণ করুন:
যে সময় সরস্বতী পূজা হয় সেই সময় বিভিন্ন রকমের ফুলের সমারোহ চারিদিকে, গাঁদা ফুল, পলাশ ফুল, এগুলি যেমন চারিদিকে খুবই চোখে পড়ে তিনি তার পাশাপাশি জুঁইফুল, পদ্মফুলও দেবীর পছন্দের ফুল। তাই সরস্বতী পূজার সময় গাঁদা ফুল, পলাশ ফুল, পদ্ম ফুল, জুঁই ফুল দিয়ে দেবীকে পূজা করতে ভুলবেন না।
৪) হলুদ মেখে স্নান:
হলুদ আমাদের ত্বকের জন্য খুবই উপকারী তা তো আমরা সকলেই কম বেশি জানি, তবে সরস্বতী পূজার দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে একটুখানি হলুদ মেখে তারপরে স্নান করা জরুরী, অল্প হলেও তবুও এটা করলে আপনি অনেক শুদ্ধ অনুভব করতে পারবেন, তারপরে সরস্বতী পূজায় বসুন।
৫) সন্ধ্যাবেলার পুজো:
সাধারণত সকাল সকাল অঞ্জলি দেওয়ার সময় থাকে। তাই সকাল সকাল সরস্বতী পূজা, অঞ্জলি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সমাপ্ত হয় এবং প্রসাদ বিতরণ করা হয়। তবে সকালবেলায় পুজো শেষ মানেই শেষ নয়। সন্ধ্যেবেলা ও রাতের বেলা অবশ্যই প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখুন মা সরস্বতীর সামনে, ঘি এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে তো আর কোন কথাই নেই।
৬) ঘুম থেকে উঠে হাত দেখুন:
এই কাজটি শুধুমাত্র সরস্বতী পূজার দিন করতে হবে এমন টা কিন্তু নয়। আপনি প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর সবার আগে নিজের হাত দেখতে পারেন। কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, আমাদের হাতে সরস্বতীর বসবাস, তাই সকালে নিজের হাত দেখলে সরস্বতীর দর্শন করা যায় বলে জানা যায়।
৭) হলুদ রঙের পোশাক:
সরস্বতী পূজায় হলুদ রঙের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, তাই এই দিন হলুদ রঙের পোশাক পরে সরস্বতী পূজায় বসা উচিত। সেই কারণে সকল ভক্তরা এবং যারা উপবাস রেখেছেন তারাও কিন্তু হলুদ রংয়ের পোশাক পরে পূজায় বসেন।
৮) দেবীকে হলুদ রঙের বস্ত্র অর্পণ করুন:
হলুদ রং দেবী সরস্বতীর খুবই পছন্দের, তাই সকালে উঠে স্নান করে পুজোর জায়গায় দেবীর মূর্তি স্থাপন করে তাকে হলুদ রংয়ের বস্ত্র অর্পণ করতে পারেন।
৯) দুই রঙের ফুল:
হলুদ এবং সাদা এই দুটি রঙের ফুল দেবীর অত্যন্ত প্রিয়, সেই কারণে বসন্ত পঞ্চমীর দিনে এই দুই রঙের ফুল দেবীকে অর্পণ করা উচিত বলে মনে করা হয়। তাছাড়া এই সময় হলুদ গাঁদা ফুল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তাই এই পূজায় গাঁদা ফুলের প্রাধান্য অনেকখানি।
১০) হলুদ চন্দন:
পূজার সময় দেবী সরস্বতী কে হলুদ রংয়ের চন্দন ও হলুদ ভোগ নিবেদন করা উচিত যেমন ধরুন হলুদ রঙের মিষ্টি, হলুদ রঙের ফল ইত্যাদি। এর ফলে জ্ঞানের দেবী খুব তাড়াতাড়ি প্রসন্ন হন এবং বৃহস্পতি মজবুত হয়।
১১) শিক্ষার সামগ্রী দান করুন:
জ্ঞানের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া খুবই পূণ্যের কাজ। আর যারা খুবই অসহায় দরিদ্র যাদের মধ্যে পড়াশোনা করার মতো কোনো বই খাতা নেই, এই দিন অর্থাৎ সরস্বতী পূজার দিন তাদেরকে শিক্ষার সামগ্রী দান করা উচিত। যেমন ধরুন বই, খাতা, কলম ইত্যাদি। যাতে তারা ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারে।
১২) ময়ূরের পালক:
কথাটা অনেকের কাছে অযুক্তিকর লাগলেও এই নিয়ম অনেকেই পালন করেন। আর এটা একটা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সরস্বতী পূজার সাথে সাথে বইয়ের পূজা করা হয় এবং সেই বইয়ের মধ্যে ময়ূরের পালক অর্থাৎ ময়ূরপঙ্খ রাখলে ছাত্রদের পড়াশোনায় একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়।
১৩) সরস্বতী মন্ত্র জপ:
সরস্বতী পূজার পাশাপাশি সরস্বতীর আরাধনার পর তার মন্ত্র জপ করলে শুভ লাভ করা যায়। আর দেবীর আশীর্বাদ পাওয়া যায়, যা জীবনে জ্ঞান, বুদ্ধি, শিল্প-কলা, সংগীত সবকিছুতে পারদর্শী হতে সাহায্য করে।
⭐ দেবী সরস্বতী খুবই শান্ত প্রকৃতির দেবী, তাই তাকে সন্তুষ্ট করতে আপনাকে বেশি কষ্ট করতে হবে না। শুধু সামান্য কিছু নৈবেদ্য আর এমন কিছু নিয়ম রয়েছে সেগুলি পালন করলেই তিনি অল্পতেই আপনার উপরে সন্তুষ্ট হবেন। আর জ্ঞান, বুদ্ধি, বিদ্যা, শিল্প-কলা, সংগীত সব কিছুই আপনার আঁচলে ঢেলে দেবেন।