হিন্দু বাঙালি দের বারো মাসে তেরো পার্বণ তার মধ্যে পৌষ পার্বণ (মকর সংক্রান্তি) একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব। হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী পৌষ পার্বণ দ্বাদশী তিথিতে মকর সংক্রান্তিতে পালিত হয়। এই দিন সূর্যের দক্ষিণায়ন শেষ হয় এবং উত্তরায়ন শুরু হয়। মকর সংক্রান্তির দিনে সূর্যের ধনু রাশিতে গোচর সমাপ্ত হয় এবং মকর রাশিতে গোচর শুরু হয়।
এই মকর সংক্রান্তির দিন থেকে শুভ কাজ শুরু করা যায়, যেমন ধরুন বিবাহ, অন্নপ্রাশন এবং আরো যে সমস্ত শুভ কাজ রয়েছে, গৃহপ্রবেশ সবকিছু কিন্তু এই মকর সংক্রান্তির পর থেকেই শুরু হয়। মকর সংক্রান্তির দিন পবিত্র নদীতে স্নান সেরে অথবা গঙ্গা স্নান করে পূজা করা এবং দান ধ্যান করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
এই দিন সকালে স্নান করে সূর্যদেবকে জল এর অর্ঘ্য দিতে হয়। তার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র দান করা হয় মকর সংক্রান্তির দিনে। কোন কোন জিনিসগুলি দান করা হয় সেগুলি সম্পর্কে হয়তো অনেকেই সবটা জানেন না।
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, মকর সংক্রান্তির দিন পুণ্য লাভ করার জন্য আপনি কোন কোন জিনিসগুলি দান করবেন:
১) খিচুড়ি:
শুনতে অবাক লাগলেও এদিন কিন্তু আপনি যদি খিচুড়ি রান্না করে দান করেন, তাহলে পুণ্য অর্জন করতে পারবেন। চাল ও কালো বিউলির ডাল দান হিসেবে দেওয়া হয়। কালো বিউলির ডাল দান করলে শনিদেব খুবই প্রসন্ন হন। এর ফলে ব্যক্তির উপর থেকে সমস্ত শনির দোষ দূর হয়ে যায়, চাল দান করলে অক্ষয় ফল লাভ করা যায়।
২) তিল:
তিন হল এমন একটি জিনিস যা থেকে তেল তৈরি হয়। আবার অনেক রকম খাবার জিনিসও তৈরি হয়। মকর সংক্রান্তির দিনে তিল দান করার প্রথা রয়েছে অনেক যুগ আগে থেকে। কালো তিল ও তিলের তৈরি জিনিসপত্র দান করলে পুণ্য অর্জন করা যায়। এর পাশাপাশি শনিদেবকে প্রসন্ন করার জন্য তিল দান করা উচিত। তার সাথে সূর্য দেব এবং বিষ্ণু দেব কিন্তু তিল দান করলে খুবই প্রসন্ন হন।
প্রতিটি কাহিনী উপলক্ষে এক একটি উৎসব, মকর সংক্রান্তির দিনে তিল দান করার পিছনে রয়েছে একটি কাহিনী। নিজের রাগী পিতা সূর্যের পুজো করার জন্য তিল ব্যবহার করেছিলেন শনিদেব। এর থেকে আনন্দিত হয়ে সূর্যদেব তাকে আশীর্বাদ দিয়েছিলেন যে, যখনই তিনি মকর রাশিতে আসবেন, তখন তিল দিয়ে পুজো করলে ও তিল দান করলে, তিনি প্রসন্ন হবেন। তিল দান করলে শনির দোষও দূর হয়ে যায়।
৩) নুন / লবন:
মকর সংক্রান্তির দিন লবণ অথবা নুন দান করার প্রথাও প্রচলিত রয়েছে। সেই অনুসারে মকর সংক্রান্তির তিন নুন দান করলে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটে, খারাপ সময় কেটে যায়। তাই মকর সংক্রান্তিতে নুন অথবা লবন দান করা খুবই শুভ বলে মনে করা হয়।
৪) গুড়:
গুড় হল মিষ্টি একটি খাবার, মকর সংক্রান্তির দিনে গুড় দান করা শুভ বলে মনে করা হয়। গুড় দিয়ে তৈরি খাবার খেলে বিশেষ ফল লাভ করা যায়, শারীরিক দিক থেকে এবং শাস্ত্রের দিক থেকেও পুণ্য অর্জন করা যায়। মকর সংক্রান্তির দিনে গুড় দান করার এই প্রথা চলে আসছে অনেকদিন আগে থেকে। গুড় হল বৃহস্পতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, এই দিন গুড় দান করলে শনি, বৃহস্পতি ও সূর্যদেব প্রসন্ন হন।
৫) শীতের পোশাক:
যেহেতু মকর সংক্রান্তি শীতকালে অনুষ্ঠিত হয়, সেই কারণে এই সময় যদি শীতের পোশাক অর্থাৎ গরম পোশাক যদি আপনি দান করেন, সে ক্ষেত্রে অনেকখানি পুণ্য অর্জন করার পাশাপাশি শুভ ফল লাভ করতে পারবেন।
কোষ্টিতে শনি ও রাহুর দোষ দূর করার জন্য মকর সংক্রান্তির দিনে উলের তৈরি জামা কাপড় দান করা শুভ। এই দিন দরিদ্র অসহায় অথবা কোনরকম আশ্রমে ওলের পোশাক, কম্বল এগুলি দান করতে পারেন।
৬) রেড়ি:
গঙ্গা স্নান করার পর মকর সংক্রান্তির দিন দরিদ্র ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে রেড়ি দান করা উচিত। এর ফলে আপনি অনেক বিপদমুক্ত হবেন আর পুণ্য অর্জন করার পাশাপাশি আশীর্বাদও পাবেন।
৭) দেশি গাওয়া ঘি:
মকর সংক্রান্তির দিনে দেশি গাওয়া ঘি এর থেকে তৈরি যেকোনো ধরনের মিষ্টি আপনি দান করতে পারেন। যা কিনা খুবই শুভ, বৃহস্পতি ও সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাই সম্মান, নাম, যশ, খ্যাতি, সুখ, শান্তি, সুবিধা লাভ করার জন্য দেশি গাওয়া ঘি দান করা আপনার জন্য অনেকখানি মঙ্গলের।
৮) গরুকে সবুজ ঘাস দেওয়া:
গবাদি পশুরা সবুজ ঘাস কতটা না পছন্দ করে তা তো আমরা সকলেই জানি। এই দিন গরুকে সবুজ ঘাস খাওয়ালে পুণ্য অর্জন করা যায় এবং গোমাতার আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
৯) নতুন কাপড়:
মকর সংক্রান্তির দিন দরিদ্র এবং অসহায়দের নতুন কাপড় অথবা বস্ত্র দান করা উচিত। তাদের মনে খুশির জোয়ার বয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আপনি অর্জন করতে পারবেন অনেকখানি পুণ্য এবং মনে প্রশান্তি।
১০) পাখিকে দানা দেওয়া:
মকর সংক্রান্তির দিন পাখিকে দানা খাওয়াতে পারেন, আর এটি খুবই শুভ বলে মনে করা হয়।
১১) তেল দান করুন:
তেল আমাদের জীবনে অনেক প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা হয়। তাই তেল ছাড়া যেমন প্রদীপ জ্বলে না, তেমনি তেল ছাড়া অনেক রান্নাও সম্ভব নয়। এর সাথে সাথে তেল দিয়ে দেবতাদের প্রসন্ন করা হয়। মকর সংক্রান্তির দিন সূর্যের পূজা করার পর শনিদেবকে প্রসন্ন করার জন্য তেল দান করা উচিত।
কোনরকম পূজা- পার্বণ, অনুষ্ঠান অথবা সারা জীবন দান ধ্যান পুণ্য অর্জন করার জন্য আমরা সকলেই মুখিয়ে থাকি। তবে এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা গুলি যদি আমাদের জীবনে থেকে থাকে, তাহলে দান করে অনেক পুণ্য অর্জন করার পাশাপাশি মনে প্রশান্তি আনা যায়, যা কিনা কখনোই টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব নয়। যদি এই সামান্য জিনিস গুলি দান করার জন্য ভগবানকে সন্তুষ্ট করার সাথে সাথে গরিবদের মনে আনন্দ জাগানো যায়, তাহলে আর কি পাওয়ার আছে জীবনে, তাই না !