রামপ্রসাদ বিসমিল কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? রামপ্রসাদ বিসমিল কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Ram Prasad Bismil in Bengali)।
রামপ্রসাদ বিসমিল্লাহ তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী সংগঠন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। শহীদ ভগৎ সিং তাকে এই বলে প্রশংসা করেছেন যে, তিনি উর্দু এবং হিন্দিতে একজন মহান কবি ও লেখক ছিলেন।
ইংরেজি থেকে এবং বাংলা থেকে “বলশেভিকো কে কার্তুত” অনুবাদ করেছিলেন। খুবই কম বয়সে তিনি বই লিখেছেন এবং তিনি স্বয়ং প্রকাশিত করেছেন সমস্ত বই। বই গুলি প্রকাশিত হয় কিন্তু ইংরেজ সরকার তার সমস্ত বই নিষিদ্ধ করে দেয়।
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, এমন বিপ্লবীর জীবনী সম্পর্কে:
সুচিপত্র
বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের জীবনী:
- নাম: রামপ্রসাদ বিসমিল
- জন্ম তারিখ: ১১ ই জুন ১৮৯৭ সাল
- জন্মস্থান: শাহজাহানপুর, যুক্ত প্রদেশ, ব্রিটিশ রাজ্য
- পিতার নাম: মুরলীধর
- মাতার নাম: মূলমতি দেবী
- জাতীয়তা: তিনি ভারতীয় বিপ্লবী ছিলেন
- প্রতিষ্ঠান: হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন
- আন্দোলন: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন
- মৃত্যু: ১৯ শে ডিসেম্বর ১৯২৭ সাল, গোরখপুর জেল, United Provinces, ব্রিটিশ ভারত
রামপ্রসাদ বিসমিলের জন্ম, শৈশব জীবন ও শিক্ষাজীবন:
১১ ই জুন ১৮৯৭ সালের রামপ্রসাদ বিসমিলের জন্ম হয়। তিনি উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুর জেলাতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল মুরলীধর এবং মাতার নাম ছিল মূলমতি দেবী। বাড়িতে বসে রামপ্রসাদকে হিন্দি অক্ষর শেখতেন।
₹ হোম লোন • ₹ পার্সোনাল লোন • ₹ বাইক লোন • ₹ কার লোন • ₹ বিজনেস লোন • ₹ শিক্ষা লোন
সেই সময় উর্দু ভাষাও ছিল খুবই প্রচলিত। যার কারণে রামপ্রসাদকে এক মৌলভী সাহেবের কাছে পাঠানো হতো। তাছাড়া পিতা রামপ্রসাদের পড়াশোনায় বিশেষ লক্ষ্য দিতেন। আর একটু বদমাইশি করলেই রামপ্রসাদকে মার খেতে হতো। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত রামপ্রসাদ সব সময় ফাস্ট হয়েছিল।
বাল্যকাল থেকেই আর্য সমাজের সম্পর্কে তিনি যোগ দেন। শাহজাহানপুর আর্য কুমার সভার স্থাপন করেন শাহজাহানপুরে আর্য সমাজ মন্দিরের স্বামীর সোমদেবের সংস্পর্শে আসেন। তার জীবনে অনেকখানি পরিবর্তন ঘটে, এরপর রামপ্রসাদ বিসমিল বিপ্লবী দলে যোগ দিয়ে “হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের” সদস্য হন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি ভাই পরমানন্দের ফাঁসির আদেশ পাঠ করেছিলেন। এই ঘটনা তার মধ্যে দেশাত্মবোধের সূচনা ঘটায়। পরবর্তীকালে তিনি স্কুল ছেড়ে কয়েকজন বন্ধুর সাথে লখনৌ চলে আসেন এবং সেখানে “মাতৃভেদী” নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করেছিলেন।
১৯১৮ সালের ২৮ শে জানুয়ারি রামপ্রসাদ বিসমিল একটি প্রচার পত্র প্রকাশ করেন যার নাম ছিল “দেশবাসীয় নাম সন্দেশ”। তার রচিত কবিতা “মেনপুরি কি প্রতিজ্ঞা”– এর সঙ্গে প্রচার পত্রটি বিতরণ করা হয়। দলের তহবিলে টাকা সংগ্রহ করার জন্য তাঁরা ১৯১৮ সালের তিন তিনবার ডাকাতি করেন।
এছাড়াও ও ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ হওয়া বইগুলি তারা বিক্রি করতে থাকে দিল্লি কংগ্রেসের হয়ে। পুলিশের তৎপরতায় বিক্রি না হওয়া বইগুলো নিয়ে বিসমিল পালিয়ে যান। দিল্লি থেকে আগ্রা যাওয়ার পথে পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলে এবং দুই তরফ থেকে গুলি চলতে শুরু করে। এই অবস্থায় তিনি যমুনা নদীতে ঝাঁপ দেন এবং পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ডুব সাঁতার কেটে পালিয়ে যান। পুলিশ অনুমান করেন যে তিনি মারা গেছেন এবং অন্যান্য সদস্যরা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে পড়েন।
তাদেরকে আগ্রা ফোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। দীক্ষিত পরবর্তীকালে দিল্লিতে পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। এরপর দীক্ষিতের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস ফাইল করা হয়। এই ঘটনাটি “মেনপুরী ষড়যন্ত্র” নামে বিখ্যাত। তবে এই মামলা তে দীক্ষিত এবং রামপ্রসাদ বিসমিল কে পলাতক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
যে বইগুলো প্রকাশিত করার জন্য এতটা ঝুঁকি নিতে হয়েছিল তাদের, তো সে ক্ষেত্রে ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত রামপ্রসাদ বিসমিল উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন গ্রামে লুকিয়ে থাকতেন এবং বিভিন্ন বই প্রকাশ করতে থাকেন। পরবর্তীকালে “সুশীলমালা” নামক সিরিজে তার সমস্ত বই প্রকাশিত হয়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রামপ্রসাদ বিসমিলের অবদান:
রামপ্রসাদ বিসমিল রচিত সারফারোশি কি তামান্না গজলটি রামপ্রসাদ বিসমিল্লাহির মাধ্যমে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। রামপ্রসাদ বিসমিল “মৈনপুর কাণ্ড” এবং “কাঁকোরী কাণ্ডে” নেতৃত্ব দিয়ে ব্রিটিশ শাসকের বুকে প্রচণ্ড ভাবে আঘাত করেছিলেন। মাত্র ১১ বছরের এই বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিল অনেক বই লিখেছিলেন এবং সেটা তিনি নিজেই প্রকাশিত করেন।
এই বিপ্লবী কাজে অর্থ সংগ্রহ করার দরকার ছিল, অস্ত্রশস্ত্র আনার জন্য। সেই কারণে তিনি একদিন শাহজাহানপুর থেকে লখনৌতে ট্রেন ভ্রমণের সময় খেয়াল করলেন যে প্রত্যেক স্টেশন মাস্টার তার কেবিনে গার্ডের মাধ্যমে টাকার ব্যাগ আনছেন।
সেই টাকার ব্যাগ লখনৌ জংশনের সুপারেনটেনডেন্টের এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারপর রামপ্রসাদ বিসমিল সিদ্ধান্ত নিলেন সরকারি অর্থ লুট করার জন্য, এটির মধ্যে দিয়ে শুরু হলো কাকোরী ট্রেন ডাকাতি।
এই ট্রেন ডাকাতি স্বাধীনতা আন্দোলনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিপ্লবীরা তাদের কার্যক্রম চালানোর জন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য ৮ ই আগস্ট ১৯২৫ সাল শাহজাহানপুরে একটি সভায় বসেন।
অনেক কথাবার্তার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, তারা সরণপুর লখনৌ চলাচলকারী ৮ টি ডাউন পেসেঞ্জার ট্রেন বহনকারী সরকারি কোষাকার লুঠ করবেন। সেইমতো ৯ ই আগস্ট ১৯২৫ এই তারিখে আশফাকউল্লাহ খান এবং অন্যান্য আটজন, রামপ্রসাদ বিসমিলের নেতৃত্বে ট্রেন লুট করেন। বলতে গেলে দিনে দুপুরের ট্রেন ডাকাতি।
অন্যরা হলেন ১) বারানসি থেকে রাজেন্দ্র লাহিরি, ২) উন্নাও থেকে চন্দ্রশেখর আজাদ, ৩) বাংলা থেকে শচীন্দ্রনাথ বকশি, ৪) কলকাতা থেকে কেশব চক্রবর্তী, ৫) রায়বেরেলি থেকে বনওয়ারী লাল, ৬) ইটাওয়া থেকে মুকুন্দী লাল, ৭) বেনারস থেকে মন্নথ নাথ, ৮) শাহজাহানপুর থেকে মুরালি লাল। মোট ১০ জন মিলে কাকোরি ট্রেন ডাকাতি করা হয়, যা কিনা ইতিহাসের পাতায় আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য বীর বিপ্লবীরা এমন সাহসিকতা দেখাতেও পিছুপা হন নি।
হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য পদ গ্রহণ করেছিলেন ভগৎ সিং ১৯২৩ সালে। রামপ্রসাদ বিসমিল নেতৃত্বে বিপ্লবী দল কাকোরীর কাছে টেনে ডাকাতি করার পরিকল্পনা করেন। দলের ১০ জন সদস্য এই অভিযানে সামিল হয়েছিলেন। তবে উত্তরপ্রদেশের লখনৌ এর কাছে কাকোরিতে সরকারি তহবিল সমেত ট্রেনে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন এই দশজন বিপ্লবী সদস্য।
এই অভিযানে জার্মান পিস্তল “মাউজার আর সি ৯৬” (Mouser RC 96) ব্যবহার করা হয়েছিল। এদের বিরুদ্ধে কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয় এবং ১৮ মাস ধরে বিচার পর্ব চলে। বিচারের অধিকাংশরই যাবজ্জীবন, দ্বীপান্তর, অথবা সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।
কিন্তু রামপ্রসাদ বিসমিল সহ তিনজন সহযোগী আশফাকুল্লাহ খান, রাজেন্দ্র লাহিড়ী ও রোশন সিং যারা কিনা মূল ভূমিকাতে ছিলেন, তাদের ফাঁসি হয়। ১৯২৭ সালে ১৯ শে ডিসেম্বর গোরক্ষপুর জেলে রামপ্রসাদ বিসমিল্লাহির ফাঁসি দেওয়া হয়, তার দেহ রাপ্তী নদীর তীরে দাহ করা হয়েছিল, বর্তমানে সেই জায়গাটি “রাজঘাট” নামে পরিচিত।
রামপ্রসাদ বিসমিল এর মৃত্যু:
এতকিছুর পর ১৯২৬ সালের “কাকোরী বিপ্লব” সংঘটিত হয় এবং এর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে, রামপ্রসাদ বিসমিল, রাজেন্দ্র লাহিরি, ঠাকুর রোশান সিং, আসফাগউল্লা খানের ফাঁসির সাজা শোনানো হয়।
১৯ শে ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে গোরখপুর জেলে তাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। আর এই ভাবেই ফাঁসির মঞ্চে হাসতে হাসতে জীবন দিয়ে গেছেন এমন সব বিপ্লবী।
রামপ্রসাদ বিসমিলের সম্মানার্থে:
তার মৃত্যুর পর স্বাধীন ভারতে তার স্মৃতিরক্ষা করার জন্য শাহজাহানপুরে তার একটি মূর্তি স্থাপন করা হয় এবং শাহজাহানপুর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে রামপ্রসাদ বিসমিল রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করা হয়। উত্তরপ্রদেশ সরকার রামপ্রসাদ বিসমিলের নামে কয়েক দিন আগে রামপুর জাগির গ্রামে একটি উদ্যান তৈরি করেছে।
মেনপুরি ষড়যন্ত্র মামলার সময় এই গ্রামেতেই রামপ্রসাদ বিসমিল আত্মগোপন করেছিলেন। এছাড়া তার জন্মবার্ষিকীতে তার স্মরণ করার জন্য ১৯৯৭ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে।
রামপ্রসাদ বিসমিলের লেখা বই:
তিনি ক্যাথরিন (Catherine) বইটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছিলেন এবং বাংলা থেকে অনুবাদ করেছিলেন “বলশেভিকো কি কার্তুত” (Bolshevikon ki Kartoot)। তাছাড়া তিনি একটি আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন যেটি তার মৃত্যুর পর গণেশ সংকর বিদ্যার্থী “কাকোরী কি শহীদ” (Kakori ki Shahid) এই বইটির অন্তর্গত করেছিলেন।
রামপ্রসাদ বিসমিল মনে করতেন যে, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই স্বাধীনতা লাভ সম্ভব হবে। যেখানে কোনরকম নরম মানসিকতা ব্রিটিশ রাজত্ব ধ্বংস করতে পারবে না। সেই কারণে রামপ্রসাদ বিসমিল তরুণদের নিয়ে একটি নতুন দল সংগঠন করেন, আর যার নাম হিন্দুস্তান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন।
সেই সময় বাংলার বাইরে বিহার, রাজস্থান, মাদ্রাজ, বোম্বাই তে বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যকলাপ হতে থাকে। বাংলার বাইরে বিপ্লবীদের যে সমস্ত সংস্থা গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশে গঠিত হিন্দুস্তান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন ছিল সবথেকে উল্লেখযোগ্য।
দেশের স্বাধীনতার জন্য কত তরুণ বিপ্লবী যে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তা হয়তো সঠিক করে জানা নেই। এমনও অনেক রয়েছেন তাদের নাম ও পর্যন্ত আমরা হয়তো জানিনা। তাদের রক্তে ভিজেছে ভারতের মাটি। তেমনই ফাঁসির মঞ্চে অনেক বিপ্লবী প্রাণ দিয়েছেন, তেমনি প্রাণ দিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল, যাঁকে ভারতবাসী আজীবন মনে রাখবেন।