রাজা রামমোহন রায় কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? রাজা রামমোহন রায় কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও রাজা রামমোহন রায়ের সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Raja Ram Mohan Roy in Bengali)।
রাজা রামমোহন রায়ের নাম শোনেননি এমন ভারতবাসী খুবই কম রয়েছেন। নবযুগের প্রবর্তক, স্বদেশ ভারতবর্ষ এবং সজাতির কল্যাণে তার অবদান কিন্তু ভোলার নয়। রাজা রামমোহন রায়ের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি সাধারণ মানুষকে অপরিসীম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। অন্যদিকে রাজা রামমোহন রায়কে মহান পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি তার পান্ডিত্য আর প্রতিভা দিয়ে সকলের মনেই বিরাজ করছেন।
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন প্রথম ভারতীয় ধর্মীয় সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন, ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাঙালি দার্শনিক। রাজনীতি জনপ্রশাসন ধর্মীয় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া রাজা রামমোহন রায় সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন সতীদাহ প্রথা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টা করার জন্য।
তখন হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে হতো, অথবা আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য বাধ্য করা হতো। সে ছিল এক মর্মান্তিক জঘন্য কর্মসূচি আর এমনই এক কর্মসূচির বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী:
তো চলুন এমনই একজন পণ্ডিত, দার্শনিক এবং সমাজ সংস্কারক ব্যক্তিত্ব রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী সম্পর্কে জানা যাক:
- সম্পূর্ণ নাম: রাজা রামমোহন রায়
- জন্ম তারিখ: ২২ শে মে ১৭৭২ সাল
- জন্মস্থান: রাধানগর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত
- পিতার নাম: রমাকান্ত রায়
- মাতার নাম: তারিনী দেবী
- পেশা: সামাজিক, ধর্মীয় সংস্কারক
- জাতীয়তা: তিনি ভারতীয়
- রাশি: মিথুন রাশি
- শহর: হুগলি
- শিক্ষা: কলকাতা, পাটনা
- প্রধান সংগঠন: ব্রাহ্মসমাজ
- আন্দোলন: বাংলার নবজাগরণ
- বয়স: ৬১ বছর (মৃত্যুর সময়)
- মৃত্যু: ২৭ শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সাল
রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম এবং পরিবার:
রাজা রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৭৭৪ সালের ১০ ই মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় রাধানগর গ্রামে। তিনি একটি জমিদার পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার পিতা ছিলেন জমিদার রমাকান্ত রায়, মাতার নাম ছিল তারিনী দেবী।
রাধানগর গ্রামে খুবই সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন রাজা রামমোহন রায় এবং পরিবারের সকলেই ছিলেন খুবই ধার্মিক স্বভাবের। যার ফলে তাদের বেশিরভাগ সময় টাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেই কেটে যেত।
রাজা রামমোহন রায়ের শৈশবকাল এবং শিক্ষাজীবন:
তিনি যে সময় জন্মেছিলেন সেই সময় কে ভারতের ইতিহাসে অন্ধকারতম যুগ বলে মনে করা হয়। তখনকার দিনে লেখাপড়া বেশিরভাগ সময় গুরু গৃহে গিয়ে করতে হতো অথবা যারা খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তাদের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে গৃহ শিক্ষক এসে পড়াশোনা করিয়ে যেতেন।
ছোটবেলা থেকেই রাজা রামমোহন রায়ের লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। তিনি ৮ বছর বয়সেই গ্রামের স্কুলে বাংলা এবং আরবি ভাষা শিখতে থাকেন।
তারপর পাটনা তে গিয়ে আরবি ও ফার্সি দুটো ভাষাতেই তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত ভাষা শেখার জন্য কাশী ধামে চলে যান এবং চার বছর সেখানে থেকে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি বেদান্ত শাস্ত্রের উপরেও গবেষণা করেছিলেন।
রাজা রামমোহন রায়ের কর্মজীবন:
তিনি শিক্ষা জীবন শেষ করার পর রংপুরের ডেপুটি কালেক্টর ডেকবি সাহেবের আমন্ত্রণে রাজস্ব বিভাগে একটি উচ্চ পদে চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। খুবই কম সময়ের মধ্যেই তিনি দেওয়ানী পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
তবে সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় এই চাকরিটি বেশিদিন করেন নি, তিনি সাহিত্য, সাধনা ও সমাজ সংস্কার মূলক কাজের জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুর্শিদাবাদে চলে যান। পরবর্তীতে কলকাতার মানিক তলায় বাড়ি কিনে সেখানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন।
আর এই মানিকতলার বাড়িতেই তিনি আত্মীয় সভা নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি বাংলায় ব্রাহ্মণ পত্রিকা এবং ইংরেজিতে ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেট নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশিত করেন।
রামমোহন রায় ছিলেন হিন্দু ধর্মের সাকার উপাসনা পদ্ধতির বিরোধী:
তিনি হিন্দু ধর্মের সাকার উপাসনা পদ্ধতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই তো তিনি কখনোই মূর্তি পূজা মানতেন না। তিনি হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী নামে একটি বইও রচনা করেন। এই বই পড়ার পর এবং নানা কারণে রামমোহনের পিতা পুত্রের উপরে খুবই রেগে যান এবং বাড়ি থেকে তাকে বেরিয়ে যেতে বলেন। রাম মোহন সেখান থেকে বের হয়ে তিব্বতে যান এবং সেখানে ঘুরতে ঘুরতে কয়েক বছর থেকে আবার ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু প্রচুর শিক্ষা অর্জন করেন ইংরেজি ভাষাতে।
এভাবে তিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সের মধ্যে আট টি ভাষা শিখে ফেলেন। রাজা রামমোহন রায় যে আট টি ভাষা শিখেছিলেন সেগুলি যথাক্রমে:- বাংলা, ইংরেজি, গ্রিক, আরবি, হিব্রু, ফার্সি, ল্যাটিন এবং উর্দু। এই ভাষাগুলিতে তিনি লিখতে পারতেন এবং পড়তেও পারতেন।
রাজা রামমোহন রায়ের “ব্রহ্মসমাজ” প্রতিষ্ঠা করা:
তিনি যদিও সমাজের কল্যাণের জন্য অনেক রকম কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তাই ১৮২৭ সালে তিনি ধর্ম সমালোচনামূলক প্রতিষ্ঠান ব্রহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন।
রামমোহন রায় তার নতুন ধর্ম মতবাদ প্রচার করেন, তিনি প্রচার করেন যে ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, যার এই অদ্বিত ঈশ্বরের উপাসক তারা হলেন ব্রাহ্ম। রামমোহন রায় প্রবর্তিত এই মতবাদ সেই সময়ে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আজও ব্রাহ্ম ধর্ম মতবাদের প্রচুর অনুসারী আছে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে।
রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা নিবারণ:
বরাবরই হিন্দু ধর্মের বিশেষ কিছু রীতি-নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন তিনি। তখনকার সময়ে সতীদাহ প্রথা ছিল খুবই বর্বর এবং হিংসাত্মক একটি প্রথা। যে প্রথাতে একটি নিরুপায় মেয়েকে জোর করে পুড়িয়ে মারা, এক প্রকার হত্যা করা বলা যেতে পারে।
সেই সময় হিন্দু ধর্মের কোন স্বামী যদি মারা যায় তাহলে সেই স্বামীর স্ত্রীকেও স্বামীর সাথে সাথে জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতি দিতে হতো আর একে বলা হত সহমরণ। এই প্রথায় স্বামীর চিতায় আত্মহতি দিয়ে নাকি সতি হওয়া যায়, বিধবা হয়ে সমাজে বেঁচে থাকার চেয়ে সতী হয়ে স্বামীর সাথে স্বর্গে চলে যাওয়াটাই তখনকার দিনে এই প্রথার একটা বিশেষ কারণ ছিল।
হিন্দু ধর্মের এই অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় খুবই আন্দোলন করেন। পরবর্তীতে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিংক এর সহায়তায় সতীদাহ প্রথা দমন করার আইন পাস করতে সক্ষম হন, রাজা রামমোহন রায়।
এভাবেই হিন্দু সমাজে ধর্মের নামে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত কুখ্যাত বর্বর সতীদাহ প্রথার সমাপ্তি ঘটে। শুধু সতীদাহ প্রথাই নয়, তার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে বাল্যবিবাহ, কন্যা পন ও গঙ্গায় সন্তান বিসর্জনের মতো আরও অনেক সামাজিক ব্যাধি, কুপ্রথাও বন্ধ হয়েছিল। যার ফলে সমাজের মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।
রামমোহন রায়ের “রাজা” উপাধি:
সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা তো আমরা সকলেই জানলাম। রামমোহনের জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ব্রিটিশ দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত মোঘল বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহ এর বৃত্তি বৃদ্ধির জন্য বিলেতে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।
বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের প্রতিনিধি রূপে বিদেশে গমন করে পার্লামেন্টে বাদশাহর পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে বাদশাহর বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এই কর্মকাণ্ডের জন্যই বাদশা রামমোহন রায় কে “রাজা” উপাধিতে ভূষিত করেন, আর সেখান থেকেই তিনি শুধুমাত্র রামমোহন নন, “রাজা রামমোহন রায়” নামে পরিচিত।
রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু:
মুঘল সম্রাটের কিছু কাজ নিশ্চিত করার জন্য রাজা রামমোহন রায়কে ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল। সেখানেই সেই কাজ পরিদর্শনকালে রাজা রামমোহন রায় ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে ২৭ শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সালে মেনিনজাইটিস এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাকে ব্রিস্টল নাগরির স্টেপলটন গ্লোভ / আর্নস ভ্যাল এ সমাহিত করা হয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে গিয়ে রাজা রামমোহন রায়ের পবিত্র দেহ সেই জায়গা থেকে সরিয়ে আরনোজভেল নামে একটি জায়গাতে সমাহিত করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে মধ্য ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
এই ভাবেই একজন সমাজ সংস্কারক, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ব্যক্তিত্ব চিরদিনের মত না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর রেখে গেলেন তার কৃতকর্ম ও অবদান, যা আজও মানুষের মনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে।