Monkeypox: মাঙ্কিপক্স ভাইরাস নিয়ে সতর্ক হোন এখন থেকেই নাহলে বিপদ। মাঙ্কি পক্সের সংক্রমণ কোন কোন কারণে ঘটছে? জানুন এই ভাইরাস সম্পর্কে সবকিছু এবং এই বিষয়ে কী বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সারা বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্কের মধ্যে মানুষের জীবনযাত্রা চলেছে। সেই রেস এখনো পর্যন্ত ভালোভাবে কাটেইনি। তার মধ্যেই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই চিন্তা বাড়াচ্ছে মাঙ্কি পক্স। ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু দেশে ইতিমধ্যে এই রোগের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। স্পেন, ইংল্যান্ড, পর্তুগালেও পাওয়া গিয়েছে এই রোগের চিহ্ন।
তবে এখনো পর্যন্ত ভারতে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনরকম খবর পাওয়া যায়নি। তবে রোগ কখনোই এক জায়গায় থেমে থাকে না। সে সারা বিশ্ব প্রদক্ষিণ করতেই ব্যস্ত থাকে। সেই কারণে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে কেন্দ্র থেকে। ইতিমধ্যে এয়ারপোর্ট এবং বিভিন্ন বন্দর এলাকায় নজরদারি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কি এই মাংকি পক্স? চিকিৎসক দের ধারণা কি? চলুন এ বিষয়ে কিছু জানা যাক:
সুচিপত্র
মাঙ্কি পক্স কি ?
নাম থেকে সরাসরি বোঝা যায় যে, এটি বানরের শরীর থেকে ছড়িয়ে থাকে। বানরের শরীর থেকে অন্য প্রাণী অথবা মানুষের শরীরে এই মাঙ্কি পক্স ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে মাঙ্কি পক্স কোন নতুন অসুখ নয়, আফ্রিকার বেশ কিছু এলাকাতে এই মাঙ্কি পক্স দেখা যেত অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়।
আরো জানা গিয়েছে যে, এটি আফ্রিকাতেও হত। এখন সেটা ইউরোপে প্রবেশ করেছে। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া জরুরী, কেননা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এই রোগ তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। চিকেন পক্সের প্রতিরোধক কিছুটা কাজ করে এই রোগের ক্ষেত্রে, ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে সেটি কমেও যায়।
সাধারণত মাঙ্কি পক্স নামক ভাইরাস দ্বারা এই রোগ হয়ে থাকে। ১৯৫৮ সালে প্রথম ড্যানিশ ল্যাবরেটরীতে বানরের মধ্যে এই ভাইরাসটি পাওয়া গিয়েছিল। মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত করা হয় ডেমোক্র্যাটিস রিপাবলিক অফ কঙ্গোতে ১৯৭০ সালে।
এর দুই ধরনের মধ্যে একটি হল পশ্চিম আফ্রিকান এবং আরেকটি হলো মধ্য আফ্রিকান, এ ক্ষেত্রে একটা জিনিস জেনে রাখা জরুরী যে, পশ্চিম আফ্রিকান (৩.৬%) এর তুলনায় মধ্য আফ্রিকার (১০.৬%) ধরনের আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি।
বারোটি দেশ যথাক্রমে, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, কানাডা, ইটালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য, সুইডেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে এই মাংকি পক্সের উপসর্গ পাওয়া গিয়েছে।
মাঙ্কি পক্সের লক্ষণ গুলি কি?
কোন রোগের প্রবেশ যদি শরীরে হয় তাহলে শরীরে কোনো না কোনো লক্ষণ আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করবেন। সে ক্ষেত্রে এই মাঙ্কি বক্স যদি আপনার শরীরে হয়ে থাকে তাহলে কি করে বুঝবেন ? তো এমন কিছু লক্ষণ দেখা দেবে যেগুলি দেখে আপনি বুঝতে পারেন যে মাংকি পক্স হয়েছে কিনা।
মাংকি পক্সে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির সাধারণত ৬ থেকে ১৩ দিনের মধ্যে আবার পাঁচ থেকে ২১ দিনের মধ্যে প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পাবে।
- জল ফুসকা ধরনের গায়ে ফোস্কা হবে,
- গায়ে বসন্তের মতো গুটি গুটি দেখা দেবে
- তার সাথে প্রচন্ড জ্বর থাকবে,
- প্রচন্ড জ্বালাও করবে ফোস্কাগুলি
- মাথা যন্ত্রণা
- কাঁপুনি থাকবে
- পিঠে এবং গায়ে ব্যথা অনুভব হবে।
- অবসাদগ্রস্ত দুর্বলতা দেখা দেবে।
- তবে গুটি বসন্ত থেকে এর প্রধান পার্থক্য হল এতে লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে, (গলা, বগল ও কুঁচকিতে কিছু গ্রন্থি থাকে সেগুলি ফুলে উঠতে থাকে)।
মাংকি পক্সের লক্ষণ হলো অনেকটা স্মল পক্স অথবা গুটি বসন্তের মত। তবে স্বস্তির বিষয় হলো এটা যে, জেনে খুবই খুশি হবেন, এটি স্মল পক্স থেকে কম সংক্রামক এবং খুবই কম গুরুতর। দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে রোগী আরোগ্য লাভ করতে পারবে, অর্থাৎ সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে। তাছাড়া এই রোগে মৃত্যুর হার খুবই কম।
অযথা চিন্তা না করে এই পক্সকে সাধারণ পক্স অথবা গুটি বসন্ত হিসেবে ধরে নিতেই পারেন, কেননা এগুলোও কোন না কোন ভাইরাসের কারণে মানুষের শরীরে দেখা দেয়, আর মাঙ্কি পক্সও ঠিক তেমনি। তাই অযথা ভয় না পেয়ে সতর্কতা অবলম্বন করুন আর খুব শীঘ্রই চিকিৎসা গ্রহণ করাটাও বাঞ্ছনীয়।
অন্যান্য পক্স এবং গুটি বসন্তের মতো এটাও কিন্তু একটা মানুষ থেকে আর একটা মানুষের ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাই সাধারণত যদি কোন ব্যক্তি এই মাঙ্কি বক্সে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে দুই থেকে চার সপ্তাহ রোগটি স্থায়ী হয় অর্থাৎ এর মধ্যে অন্য কারো শরীরে সেটি প্রবাহিত হতে পারে তাই সতর্কতা অবশ্যই অবলম্বন করবেন।
এই সংক্রামক রোগ চার সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে, এই রোগ ক্রমশই উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে। মাংকি পক্স আসলে মাংকি ভাইরাস। তবে একটা কথা বলে রাখা জরুরী যে, মনে করা হচ্ছে সঠিক সচেতনতা যদি অবলম্বন না করা হয় তাহলে করোনার মত এই রোগটাও অতি মারির রূপ ধারণ করতে পারে। তাই সতর্ক থাকাটা জরুরী।
এছাড়া আমেরিকাতেও এক ব্যক্তির দেহে এই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া প্রথম মাঙ্কি ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর হদিশ পাওয়া যায় লন্ডনে। যিনি কিনা মাঙ্কি পক্সে ভুগছিলেন, সেই ব্যক্তি কিছুদিন আগে নাইজেরিয়া থেকে ফিরেছিলেন।
আবার অন্যদিকে দেখতে গেলে দেখা যায় যে, এতদিন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল ক্ষতস্থান, শ্বাসনালী, মুখ, নাক, ইত্যাদির মাধ্যমে মানব শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। কিন্তু সম্প্রতি মাংকি ভাইরাসে আক্রান্ত একাধিক ব্যক্তিকে পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা মনে করছেন যে, যৌন সংসর্গের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
পোশাক অথবা ড্রপলেটের মাধ্যমেও শুধু নয়, যৌন সংসর্গের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে মাঙ্কি ভাইরাস। তাই সতর্কতা অবলম্বন করা অবশ্যই জরুরী। ইতিমধ্যে কিন্তু বিশ্বের ১২ টি দেশের ৯২ জন মানুষের মধ্যে এই রোগটি দেখা দিয়েছে।
মাংকি পক্সের জটিলতা:
কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় মাঙ্কি পক্সের কারণে শরীরে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন ধরুন, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন ধরুন ব্রেইন, চোখ, ফুসফুস এগুলি তে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়তে পারে।
চোখের কর্নিয়ায় ইনফেকশন ছড়িয়ে গেলে রোগী দৃষ্টিশক্তি ও হারিয়ে ফেলতে পারে, তবে সেটা খুবই চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে।
মাঙ্কি পক্স যেভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে:
- এই রোগ যেহেতু অন্যান্য পক্সের মত, তাই সাধারণত মানুষ থেকে মানুষের খুবই সহজে বিস্তার লাভ করে না। কিন্তু আক্রান্ত প্রাণী অথবা ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে এলে অথবা শরীরে থাকা ক্ষত বা ফোসকার সংস্পর্শে এলে এই রোগ সুস্থ শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রোগ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হতে পারে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, থুতু, অথবা দীর্ঘক্ষন মুখোমুখি আলাপচারিতার ফলেও মাংকি পক্স ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- এছাড়া বলা যেতে পারে যে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র যেমন ধরুন পোশাক তোয়ালে বিছানা এগুলির সংস্পর্শে এলে বা শরীরের সাথে স্পর্শ করলে সেখান থেকেও এ রোগের বিস্তার হতে পারে।
- সেই কারণে এগুলি থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
মাংকি পক্সে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা :
- এই রোগের লক্ষণ অনুসারে কারো শরীরে ফুসকুড়ি এবং সঙ্গে যদি জ্বর থাকে, অবসাদগ্রস্ত অথবা অস্বাভাবিক দুর্বলতা দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সেখানে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাঙ্কি পক্স ভাইরাসের পরীক্ষা করাতে হবে।
- সনাক্তকরণের জন্য পি সি আর (PCR) পরীক্ষা এখনও পর্যন্ত সবথেকে নির্ভরযোগ্য।
- এছাড়া বায়পসির মাধ্যমেও এই রোগটি নির্ণয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ত্বকের ক্ষতস্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যায়।
- মাঙ্কি পক্স ভাইরাস তে সাসপেক্টেড অথবা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই শরীরে ফুসকুড়ি ঝরে যাওয়া পর্যন্ত আলাদা অবস্থান করতে হবে অর্থাৎ সবার থেকে আলাদা থাকতে হবে।
- চিকিৎসকের দেওয়া পরামর্শগুলি খুবই ভালোভাবে মেনে চলতে হবে। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তি কে যিনি সেবা করবেন অবশ্যই যথাসম্ভব নিজেকে সুরক্ষার মাধ্যমে সেই ব্যক্তিকে সেবা প্রদান করতে হবে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি যে মাংকি বক্সের কোনরকম নির্দিষ্ট চিকিৎসা কিন্তু নেই। তাই এই রোগে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায় সেগুলো কমানোর জন্য চিকিৎসক ওষুধ প্রদান অবশ্যই করে থাকবেন কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, স্মল পক্স অথবা গুটি বসন্তের টিকা এই রোগ প্রতিরোধে প্রায় ৮৫% পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে। এছাড়াও অনেক দেশে এন্টিভাইরাল এবং এমিউনোগ্লোবিন ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি, তবুও রোগের প্রকোপ কমাতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মাঙ্কি পক্স প্রতিরোধ:
তো চলুন জেনে নেওয়া যাক, এই মাঙ্কি পক্স প্রতিরোধ করার জন্য আপনার কি কি করণীয় ?
মাংকি পক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে গেলে নিচের এই বিষয়গুলি যথাযথভাবে মেনে চলা অবশ্যই প্রয়োজন:-
- কোন পরিবারে কেউ যদি এই রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে আলাদা ঘরে তাকে রাখতে হবে এবং পরিবারের সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
- মাঙ্কি পক্সের উপসর্গ রয়েছে এমন ব্যক্তির খুব কাছাকাছি থেকে কথা বলা যাবে না এবং শারীরিক সংস্পর্শ অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।
- এই রোগে আক্রান্ত হওয়া অবস্থায় যথাসম্ভব যৌন মেলামেশা এড়িয়ে চলা উচিত, বিশেষ প্রয়োজনে কনডম ব্যবহার করা যেতে পারে।
- মাংকি পক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা কোন জিনিসপত্র সুস্থ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে যেন না থাকে।
- যেহেতু এই ভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে, সেহেতু সার্জিকাল মাস্ক পরাটা জরুরী।
- নিয়মিত সাবান অথবা অ্যালকোহলসম্পন্ন হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
- আর একটা জরুরী বিষয়, যখন বাড়িতে মাংস রান্না হবে, রান্নার সময় অবশ্যই সেই মাংস ভালোমতো সিদ্ধ করে রান্না করবেন।
- অসুস্থ অথবা মৃত অথবা বন্য কোন প্রাণীর সংস্পর্শ থেকে সব সময় দূরত্ব বজায় রাখুন।
আশা করি এই সমস্ত করণীয় বিষয়গুলি আপনার পরিবারের ভালোর জন্য অবশ্যই অবশ্যই পালন করবেন, কি তাই তো ! তাছাড়া খুবই কম সময়ের মধ্যে এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়, তাই অযথা অতিরিক্ত চিন্তা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে আক্রান্ত ব্যক্তির দেখভাল করাটা জরুরী এবং পরিবারের আরো অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের কে সমস্ত রকম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবেই কিন্তু এই রোগকে অতিমারির রূপ নেওয়া থেকে আটকানো যাবে।
খুশির খবর এটাই যে, এখনো পর্যন্ত ভারতে মাংকি পক্স এর লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই আগে থেকে যদি সতর্কতা অবলম্বন করা যায়, তাহলে কখনোই এই মাঙ্কি পক্স ভারতে প্রবেশ করতে পারবে না আশা করা যায়। সকলেই সতর্ক, থাকুন সুস্থ থাকুন।