মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Maulana Abul Kalam Azad in Bengali)।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বহু বিপ্লবী এবং সংগ্রামী তাদের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন। তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগ্রামীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হলো মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, তিনি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, আবুল কালাম আজাদ ছিলেন একজন কবি, লেখক পাশাপাশি সিনিয়র সাংবাদিক ও।
তার আসল নাম ছিল আবুল কালাম গোলাম মহিউদ্দিন। তাছাড়া একটি কথা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে, তিনি ধর্মের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার উপাধি পরিবর্তন করে আজাদ রাখেন, আর সেখান থেকে তিনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নামে সকলের কাছে পরিচিত।
মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জীবনী:
তো চলুন এমন একজন উদার মনের মানুষের পাশাপাশি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনী সম্পর্কে জানা যাক:
সম্পূর্ণ নাম: | সৈয়দ গোলাম মহিউদ্দিন আহমদ বিন খাইরুদ্দীন আল হুসাইনী |
তিনি যে নামে পরিচিত: | মৌলানা আবুল কালাম আজাদ |
জন্ম তারিখ: | ১১ নভেম্বর ১৮৮৮ |
জন্মস্থান: | মক্কা, সৌদি আরব |
পিতার নাম: | মোঃ খায়রুদ্দিন বিন আহমেদ |
মায়ের নাম: | শেখ আলিয়া বিনতে মোহাম্মদ |
স্ত্রীর নাম: | জুলেখা বেগম |
কর্মজীবন: | রাজনীতিবিদ, বিপ্লবী, সমাজকর্মী |
জাতীয়তা: | ভারতীয় |
রাজনৈতিক দল: | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস |
পুরস্কার: | ভারতরত্ন |
মৃত্যুর তারিখ: | ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ সাল (বয়স ছিল ৭০ বছর) |
মৃত্যুর কারণ: | হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন |
মৃত্যুর স্থান: | দিল্লি, ভারত |
মৌলানা আবুল কালাম আজাদের শৈশব জীবন এবং শিক্ষা জীবন:
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ১১ই নভেম্বর ১৮৮৮ সালের মুসলিমদের প্রধান ধর্মস্থান সৌদি আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম ছিল মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন, তিনি একজন বাঙালি মৌলানা ছিলেন যিনি ছিলেন একজন চরম উগ্রপন্থী। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মা ছিলেন আরব থেকে।
যিনি ছিলেন শেখ মোহাম্মদ জহর ওয়াত্রী এর কন্যা। যিনি কিনা মদিনার একজন আলেম ছিলেন, যার নাম সারা আরব ছাড়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশে খুবই জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত ছিল। মৌলানা আজাদের বয়স যখন সবে মাত্র দুই বছর তখন তার পরিবার ১৮৯০ সালে আরব থেকে ভারতে ফিরে আসেন। এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
আবুল কালাম আজাদ মুসলিম ধর্মের ইসলামিক শিক্ষাকে বেছে নেন, তাছাড়া তিনি তার বাবার কাছে মুসলিম ধর্ম গ্রন্থ সম্পর্কে জানতেন, পড়তেন এবং পরবর্তীতে একটি শিক্ষক বাড়িতে এসে তাকে পড়িয়ে যেতেন। তবে এত কম বয়সে তিনি গণিত, জ্যামিতি, দর্শন, ইংরেজি ভাষা, বীজগণিত, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মত বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে থাকেন।
যার কারণে ছাত্রদের মধ্যে তিনিই একমাত্র মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এছাড়া ১৬ বছর বয়সে তিনি অনেক কঠিন কঠিন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার ক্ষমতা রাখতেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ খাইরুর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন, আর তার এই উচ্চশিক্ষা রাজনৈতিক জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মৌলানা আবুল কালামের কর্মজীবন:
যেহেতু তিনি খুবই কম বয়সে অনেক কিছু জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন, সেই কারণে খুবই অল্প বয়সেই অনেক পত্রিকায় কাজও করেছেন তিনি। মৌলানা সাপ্তাহিক আল মিসওয়াহ পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। মুসলিম যুবকদের বিপ্লবী আন্দোলনে উৎসাহিত করা, জনগণের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলাই ছিলো সেই সাপ্তাহিক পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। তিনি সাধারন মানুষের শাসনের জন্য ব্রিটিশ সরকারকেই একমাত্র দায়ী করতেন।
এছাড়া ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গর বিরোধিতা করেন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইরাক, সিরিয়া, মিশর, আফগানিস্তান এবং তুরস্ক তে গিয়েছিলেন। যেখানে তার চিন্তাধারা অনেকখানি পরিবর্তিত হয়েছিল এবং তার বিশ্বাস অনুসারে একজন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী হিসাবে সবার সামনে আসেন।
১৯২০ সালে রাঁচিতে তিনি কারাগারে বন্দী হয়ে পড়েন, তারপর জেল থেকে বেরিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। এছাড়াও খিলাফত আন্দোলনের প্রধানও ছিলেন তিনি। এছাড়া আজাদ ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষা মন্ত্রী।
মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি অর্থাৎ আইআইটি নাম দেওয়া হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।
যেমন ধরুন সংগীত নাটক একাডেমিক (১৯৫৩), অ্যাকাডেমী অফ ফাইন আর্টস (১৯৫৪), সাহিত্য একাডেমী (১৯৫৪), তাছাড়া তার কর্মজীবনের মধ্যে সেন্ট্রাল এডভাইসারি বোর্ড অফ এডুকেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ও তিনি নিযুক্ত ছিলেন।
সরকারকে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য অনুরোধ করেছিলেন তিনি। এছাড়া ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুর জন্য বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদান, মেয়েদের শিক্ষা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কৃষি শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, এই সমস্ত বিষয়ে তিনি উৎসাহ প্রদান করেন, এই সমস্ত বিষয়ে আবুল কালামের খুবই বড় অবদান ছিল।
মৌলানা আবুল কালাম আজাদের অসহযোগ:
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ যখন খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন, ঠিক সেই সময় তিনি মহাত্মা গান্ধীর সংস্পর্শে আসেন। আবুল কালাম আজাদ ১৯১৯ সালের রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ এর ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলন সংগঠনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
আবুল কালাম আজাদের কংগ্রেস নেতা হয়ে ওঠা:
১৯২৩ সালে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন, তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের সবথেকে সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি।
এছাড়া ১৯৩১ সালে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন আর ঠিক এই সময় থেকেই তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। তিনি সবসময়ের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা তার পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা প্রচার করতেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন:
১৯৪২ সালের প্রথম দিকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি যখন খুবই জোরালো হয়ে পড়ে, তখন যুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সার্বিক সমর্থন এবং অংশগ্রহণ লাভের আশা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অনুরোধে ভারতীয় সমস্যা সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার তাদের মনোভাব বদল করে।
যুদ্ধের শুরুর দিকে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বিভিন্নভাবে গান্ধীজিকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আন্দোলন করার কথা বললেও তিনি গুরুত্ব না দিলেও জাপানি বাহিনীর ভারত আক্রমণের আশঙ্কা কে কেন্দ্র করে গান্ধীজীর নতুন করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কথা বলেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং জওহরলাল নেহেরু গান্ধীজীর এই মত কে সমর্থন করতে পারেননি।
মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ভয় ছিল যে, ভারতীয় সীমান্তে যখন শত্রুপক্ষ দাঁড়িয়ে থাকবে, ব্রিটিশ সেই সময় সঙ্ঘবদ্ধ কোন আন্দোলন সহ্য করবে না। সব কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তার করা সহ প্রয়োজনের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমন করবে তারা।
এরপর ১৯৪২ সালের ১৪ ই জুলাই মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং জওহরলাল নেহেরুর সমর্থন ছাড়াই কংগ্রেস ব্রিটিশ বিরোধী অহিংস বিপ্লব ভারতছাড়ো আন্দোলন ঘোষণা করে এবং পরবর্তীকালে মৌলানা আজাদ এর আশঙ্কাই কিন্তু সত্যি হয়। এরপর সরকার গান্ধীজীর সহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জেলে পাঠায় এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়।
ভারত বিভাগ ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদ:
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ব্রিটিশ ভারত ভেঙে হয়ে পাকিস্তান রাজ্য, ভারত নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হয়। পাকিস্তান পরবর্তীকালে আবার বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ নামে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের ফলে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ভেঙে পাঞ্জাব প্রদেশ যেটা পাকিস্তান ও পাঞ্জাব রাজ্য (ভারত) গঠিত হয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের বিপক্ষে অবস্থান করেন, বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে তিনি এর তীব্র বিরোধিতা করে বক্তব্য রেখেছেন।
তিনি মনে করেন পাকিস্তান সৃষ্টির কল্পনা একটা ঘৃণা থেকে জন্ম নিয়েছে এবং যতদিন ঘৃণা বেঁচে থাকবে ততদিনই এর অস্তিত্ব থাকবে। এই ঘৃণা ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ককে গ্রাস করে ফেলবে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্ব হওয়া বা শান্তিপূর্ণ অবস্থা কখনোই সম্ভব নয়।
দেশ বিভাগের এই রাজনীতি এই দুটি দেশের মধ্যে এক বিরাট প্রাচীর তৈরি করে দেবে। পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের সব মুসলমানকে সেখানে স্থান দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ তার জায়গা অনেকটাই কম, পক্ষান্তরে হিন্দুদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করা সম্ভব নয়। তার ফলে আজও কিন্তু সেই ভাবে সম্প্রীতি বজায় নেই।
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এর পুরস্কার এবং সম্মান:
#১) ১৯৮৯ সালে মৌলানা আজাদ এর জন্মদিনে দেশের শিক্ষার প্রচারের জন্য ভারত সরকার মৌলানা আজাদ শিক্ষা ফাউন্ডেশন তৈরি করেছিল।
#২) তিনি ১৯৯২ সালে ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত হন।
#৩) জাতীয় শিক্ষা দিবস প্রতিবছর ১১ ই নভেম্বর মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মবার্ষিকীতে পালিত হয়ে আসছে।
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এর মৃত্যু:
তিনি ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ সালে যখন ৭০ বছর বয়স ছিল তখন তিনি হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, যখন তিনি মারা যান তিনি ভারতের দিল্লিতে ছিলেন।
খুবই কম বয়সে তিনি সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে দক্ষ ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, তাছাড়া তিনি সম্প্রীতির বীজ বুনে গিয়েছেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে তিনি সকলের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।
স্বাধীন ভারতের শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে তিনি বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষার জন্য আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করেন। তিনি কিন্তু ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন স্থাপন করে গিয়েছেন।
তাকে স্মরণ করে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে প্রতিবছর ১১ ই নভেম্বর মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্ম তারিখে পালন করা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে তার যোগদান, বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করার মধ্যে দিয়ে তিনি তার অবদান রেখে গেছেন ভারতবাসীর কাছে।