মহাত্মা গান্ধী জীবনী 2023 – ইতিহাস, পরিবার এবং স্বাধীনতা আন্দোলন কার্যক্রম

মহাত্মা গান্ধী কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? মহাত্মা গান্ধী কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Mahatma Gandhi in Bengali)।

মহাত্মা গান্ধী যাকে অনেকেই জাতির জনক (Rashtrapita) বলে চেনেন। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অহিংস আন্দোলনের নেতা। সশস্ত্র সংগ্রাম মহাত্মা গান্ধী কখনোই পছন্দ করতেন না। আর সেই কারণে তার নেতৃত্বে ভারতে আস্তে আস্তে স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে, এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়।

আর আমাদের দেশ ভারতবর্ষে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

মহাত্মা গান্ধী জীবন পরিচয় - Mahatma Gandhi Biography in Bengali
মহাত্মা গান্ধী জীবন পরিচয় – Mahatma Gandhi Biography in Bengali

অন্যতম ভারতীয় রাজনীতিবিদ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রগামী ব্যক্তিত্বের একজন এবং প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা ও বলা যায়। তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অহিংস মতবাদ এর উপর ভিত্তি করে এবং এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি।

তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জীবনী সম্পর্কে: 

মহাত্মা গান্ধীর জীবনী:

  • সম্পূর্ণ নাম: মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অথবা মহাত্মা গান্ধী
  • জন্ম তারিখ: ২ রা অক্টোবর ১৮৬৯ সাল
  • জন্মস্থান: পোরবন্দর, গুজরাট, ব্রিটিশ ভারত
  • পিতার নাম: করমচাঁদ উত্তমচাঁদ গান্ধী
  • মাতার নাম: পুতলি বাই গান্ধী
  • জাতীয়তা: তিনি ভারতীয়
  • অন্যান্য নাম: বাপুজী, গান্ধীজী, মহাত্মা গান্ধী
  • শিক্ষা: ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন
  • পেশা: তিনি উকিল ছিলেন, রাজনীতিবিদ, একাধারে আন্দোলনকারী এবং লেখক
  • কর্মজীবন: ১৮৯৩ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল
  • পরিচিতির কারণ: ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, অহিংস আন্দোলন,
  • স্ত্রীর নাম: কস্তুরবা গান্ধী / কস্তুরী বাই গান্ধী
  • রাজনৈতিক দল: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
  • সন্তান: চারজন সন্তানের নাম ১) মনিলাল, ২) রামদাস, ৩) হরিলাল, ৪) দেবদাস
  • মৃত্যু: ৩০ শে জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল।

মহাত্মা গান্ধীর জন্ম এবং পরিবার: 

তিনি ভারতের কাথিয়াবাড় প্রদেশের পোরবন্দর নামক স্থানে একটি প্রাচীন বেনিয়া পরিবারে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ২ রা অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। গান্ধীজীর পূর্বপুরুষরা বংশানুক্রমে কাটিয়াবাড় প্রদেশের পোরবন্দর নামক স্থানের দেওয়ান ছিলেন।

মহাত্মা গান্ধীর পিতার নাম ছিল করমচাঁদ উত্তম চাঁদ গান্ধী, তাছাড়া মহাত্মা গান্ধীর ডাক নাম ছিল কাবা গান্ধী। গুজরাটে সামাজিক নিয়ম হল ছেলের নামকরনের সময় বাবার নামও ছেলের নামের সাথে যুক্ত করতে হয়, আর সেই নিয়ম অনুসারে করমচাঁদের ছেলে মোহনদাসের নামের সঙ্গে তার বাবার নাম জুড়ে রাখা হয়েছিল বলে গান্ধীজীর সম্পূর্ণ নাম হলো, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং তিনি ছিলেন তার পিতার সবথেকে ছোট ছেলে।

মহাত্মা গান্ধীর মায়ের নাম পুত্তলি বাই, তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবতি একজন মহিলা। পূজা আর সূর্যদর্শন না করে তিনি কোনদিন জল পর্যন্ত পান করতেন না।

মহাত্মা গান্ধীর শৈশবকাল: 

খুবই ছোটবেলা থেকে শৈশবকালে শিক্ষা তিনি কাটিয়াবাড়ী তেই সমাপ্ত করেছিলেন। এরপর বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার এর পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে বোম্বাই হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তাছাড়া বলা যায় যে, তিনি শৈশবকালে সত্য এবং সাহসের মন্ত্র পেয়েছিলেন তার বাবার কাছ থেকে।

মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন উপবাস করা এবং কঠোর ব্রত পালনের শিক্ষা। যেটা তিনি নিজের জীবনে পরবর্তীতে প্রয়োগ করেছিলেন। মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা ইত্যাদি কে পাপকর্ম বলে মনে করতেন, আর সেই কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবী এবং সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন,  স্বাধীনতা আন্দোলনে সেটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষাজীবন: 

১৮ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্রিক অথবা মাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বড় ভাই মহাত্মা গান্ধীকে বিলেতে পাঠানো জন্য চিন্তাভাবনা করলেন এবং সেখানে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য গেলেন। তখনকার দিনে কুসংস্কার আচ্ছন্ন ভারতীয় হিন্দু সমাজে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া ছিল খুবই পাপের কাজ।

আর এই কারণে রাজকোটের অনেক সমাজপতি বড় ভাইকে এবং তাদের পরিবারকে সমাজচ্যুত করার হুমকি দিয়েছিল কিন্তু গান্ধীজীর নিজে ব্যারিস্টারি পড়াশোনা করার জন্য খুবই আগ্রহ প্রকাশ করেন আর সেই কারণে মা পুতলিবাই রাজি না হওয়া সত্ত্বেও ছেলের ভবিষ্যৎ এবং মঙ্গল কামনা করে বিলেতে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।

তিনি বিলেতে গিয়েছিলেন ১৮৮৮ সালের ৪ ঠা সেপ্টেম্বর এবং ১৮৯১ সালে মহাত্মা গান্ধী ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে আসেন এবং এসে শোনেন যে তার মা মারা গিয়েছেন। কিছুদিন পর মহাত্মা গান্ধী আইন ব্যবসা শুরু করেন কিন্তু মহাত্মা গান্ধী অনেকটা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন, সেই কারণে প্রথম দিকে আইন ব্যবসায় তেমন কোন সুবিধা করতে পারেননি।

মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত জীবন:

অনেক আগে তখন খুবই কম বয়সে ছেলে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া হতো। সেই অনুসারে সমাজের রীতিনীতি মেনে মাত্র ১৩ বছর পার হতেই মহাত্মা গান্ধীকে বিয়ে দেওয়া হয় কস্তুরবা / কস্তুরী বাই নামে তারই সমবয়সী একজন কিশোরীর সঙ্গে। ১৬ বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধী প্রথম সন্তানের পিতা হন। সেই সাথে নিজের পিতা কেও চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেন।

নেটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা:

মহাত্মা গান্ধী ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের নিয়ে নেটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় নেটাল সরকার এশিয়াটিক এক্স ক্লশন অ্যাক্ট অর্থাৎ এশিয়াবাসী বিতরণ নামক একটি আইন পাস করে। মোহনদাস এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের ধন্যবাদ পেয়েছিলেন।

নেটাল ও ট্রান্সভালে ভারতীয়দের দুরাবস্থার বিষয় টি সরকারকে জানাতে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী ভারতে আসেন। তারপরে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্যবাদী শ্বেতাঙ্গরা তার প্রতি অত্যন্তই রেগে যান। সেখান থেকেই রাজনীতিতে গান্ধীজীর প্রথম হাতে খড়ি হয়। 

মহাত্মা গান্ধীর  ট্রান্সভাল যাত্রা: 

তিনি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের একটি জটিল মামলার প্রয়োজনে নেটাল যাত্রা করেন, পরবর্তীতে সেখান থেকে ট্রান্সভাল যাত্রা করেছিলেন।

মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন: 

দেশে তখন ব্রিটিশদের শাসন আর অত্যাচার মানুষকে অতিষ্ট করে তুলেছিল। নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালে সেপ্টেম্বর মাসের কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ সিলেকশন গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন এবং একই সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রস্তাব দিতে হয়।

এছাড়া আন্দোলন ক্রমশই বাড়তে শুরু করে। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়া আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং মহাত্মা গান্ধী সেই সময় জেলে বন্দিও হন অনেকবার।

ভারত আর পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়া: 

অপরদিকে দেখা যায় মুসলিমদের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার জন্য ভারত ভাগ করে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশরা ভারতের স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকার করে অর্থাৎ ভারত স্বাধীনতা লাভ করবে এমনটাই ঘোষণা করা হয়।

ভারতের স্বাধীনতা লাভ:

এরপর বহু বিপ্লবীদের প্রাণ বিসর্জন, বহু আন্দোলন এবং দেশভাগের মূল্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে।

সেই বছরেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য গান্ধীজির নোয়াখালী সফর ভারত এর ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এছাড়া ভারত ভাগ হয়ে যায় দুটিতে, ভারত ও পাকিস্তান। আর পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে একদিন আগে, ১৪ ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে।

মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু: 

মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, এটা আমরা সকলেই কম বেশি জানি। ১৯৪৮ সালের ৩০ শে জানুয়ারি, দিল্লিতে একটি প্রার্থনা সভাতে গান্ধীজিকে একজন আততায়ীর হাতে নিহত হতে হয়। তার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন সমস্ত ভারত বাসী।

তার সাথে সাথে বিশ্ব এর শ্রেষ্ঠ নাট্যকার এবং বিশ্ব বিখ্যাত মনীষী জর্জ বার্নারড গান্ধীজীর এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে শোক প্রকাশ করে বলেন যে,

“খুব ভালো মানুষ হওয়াটাও কিন্তু একটা বিপদজনক ব্যাপার। তাকে বাঁচতে দেওয়া হয় না”

গান্ধীজীর জীবন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি সকলের মনে আজ মহাত্মা গান্ধী তথা জাতির জনক রূপে স্বীকৃতি লাভ করে রয়েছেন।

তিনি সত্য, প্রেম, ত্যাগ, সেবা ও অহিংসাকেই জীবনের মূল মন্ত্র বলে মনে করতেন। সারাটা জীবন খুবই সহজ সরল ভাবে জীবন যাপন করেছেন। তাছাড়া মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকী উৎসব দেশের সর্বত্রই পালন করা হয়। তার মধ্য দিয়ে তাঁকে সম্মান জানানো হয়ে থাকে, বিভিন্ন জায়গায় তার মূর্তি আমাদের চোখে পড়ে।

বিদেশি বস্ত্র পরিহার করার জন্য চরকা দিয়ে সুতো কেটে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাই তাঁর চরকাও কিন্তু এই আন্দোলনে অতপ্রতভাবে জড়িত ছিল। বিদেশি বস্ত্র পরিহার করা এবং তার সাথে দেশি বস্ত্র কে গ্রহণ করা, এই বিষয়টিকে চরকার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা হতো।

তাছাড়া আমাদের দেশের মুদ্রা অথবা টাকাতে তার হাস্যরত ছবি আমরা দেখি। তার পেছনে সমস্ত ভারতবাসী কিভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সেটা আমরা সকলেই কমবেশি শুনেছি। বৃদ্ধ বয়সেও লাঠি হাতে, ধুতিও চশমা পরিহিত এই ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পরেও স্বাধীনতার এক বছর পর আততায়ীর হাতে নিহত হন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top