লতা মঙ্গেশকর জীবনী 2023: শিক্ষা, কেরিয়ার, পরিবার, ইনকাম এবং অন্যান্য বিবরণ

লতা মঙ্গেশকর জীবনী ( Lata Mangeshkar Biography in Bengali) লতা মঙ্গেশকর কে? কি করেন? কোথায় বাড়ি? জীবনে কিভাবে সফল হয়েছেন? লতা মঙ্গেশকর এর জীবন পরিচয়, পরিবার, শিক্ষা, মোট ইনকাম, পুরস্কার ও অনান্য বিবরণ জানুন।

সংগীত, সুর আমাদের সকলেরই প্রিয়। সুন্দর গানের মধ্যে দিয়ে আমাদের অস্থির মন নিমেষে শান্ত হতে পারে। এই সঙ্গীতের কিংবদন্তি সংগীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর এক উজ্জ্বল নাম।

তিনি তার শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে এক বিশেষ জায়গা করে রয়েছেন। লতা মঙ্গেশকরের নাম সকলে এক ডাকেই চেনেন, তার সুমধুর কণ্ঠস্বর যেন কানে ধ্বনিত হয় সর্বদাই।

এমনকি শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে কার অবদান সবচেয়ে বেশি, এই প্রশ্ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে একটি নমুনা সমীক্ষা করা হয়েছিল ইন্ডিয়ার টু-ডে পত্রিকার পক্ষ থেকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঠক পারঠিকা দের ভোটের ফলাফল হিসেবে দেখা গিয়েছিল লতা মঙ্গেশকরের নাম সবার প্রথমে।

লতা মঙ্গেশকর জীবনী: শিক্ষা, কেরিয়ার, পরিবার, ইনকাম এবং অন্যান্য বিবরণ
লতা মঙ্গেশকর জীবনী: শিক্ষা, কেরিয়ার, পরিবার, ইনকাম এবং অন্যান্য বিবরণ

সেখানে ভীমসেন যোশী, মকবুল ফিদা হোসেন, সত্যজিৎ রায়, রাজ কাপুর এমনকি অমিতাভ বচ্চনের মতো কিংবদন্তীরাও স্থান পেয়েছেন লতা মঙ্গেশকরের নিচের সারিতে।

এমন উচ্চতায় লতা মঙ্গেশকর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, আজ থেকে শত বছর পরেও হয়তো এই উপমহাদেশের কোন প্রান্ত থেকে বা ইউরোপ আমেরিকায় কাউকে না কাউকে গেয়ে উঠতে দেখা যাবে লতা জির গানের কলি।

এখানে সময়কে অতিক্রম করে লতা আজও সকলের মাঝে অনন্যা। সুর ও সঙ্গীতের এই বিশ্বে লতা মঙ্গেসকার যেন এক আশ্চর্য বিষয়, তার গলার স্বর যেন ষোড়শী কন্যার মতো।

তো চলুন তাহলে আজ জেনে নেওয়া যাক লতা মঙ্গেশকরের জীবনের কিছু দিক সম্পর্কে:

লতা মঙ্গেশকর, তিনি হলেন ভারতের একজন স্বনামধন্য গায়িকা। বহু ছবিতে গান গেয়েছেন, এছাড়া ভারতের ৩৬ টি আঞ্চলিক ভাষাতেও গান গেয়েছেন। তার পাশাপাশি বিদেশী ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ড কিন্তু রয়েছে তাঁরই।

লতা মঙ্গেশকরের জীবনী সংক্ষেপে জানা যাক:

নাম: লতা মঙ্গেশকর
জন্ম তারিখ: ২৮ শে সেপ্টেম্বর ১৯২৯
জন্মস্থান: ইন্দোর, ব্রিটিশ ভারত (মধ্যপ্রদেশ)
পিতার নাম: দ্বীননাথ মঙ্গেশকর
মাতার নাম: শিবন্তি মঙ্গেশকর
ধরন: চলচ্চিত্রের গান
কর্মজীবন: ১৯৪২ থেকে ২০২২
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: ভারতরত্ন (২০০১), পদ্ম বিভূষণ (১৯৯৯), দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ,১৯৮৯), মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭), এন.টি.আর. জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), পদ্মভূষণ (১৯৬৯)
বাদ্যযন্ত্রসমূহ: কণ্ঠশিল্পী
আত্মীয়-স্বজন: ঊষা মঙ্গেশকর (বোন), আশা ভোঁসলে (বোন), মিনা মঙ্গেশকর (বোন), হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর (ভাই)
মৃত্যু: ৬ ই ফেব্রুয়ারি ২০২২

লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ও পরিবার:

লতা মঙ্গেশকর, তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২৯ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর। তৎকালীন ইন্দোর রাজ্যের রাজধানী ইন্দোরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যা বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ।

পিতার নাম ছিল পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর, তিনি একজন মারাঠি ও কঙ্কিনি সংগীত, অভিনেতা। আর মায়ের নাম ছিল শিবন্তী। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তিত করে সুধামতি রেখেছিলেন তিনি।

লতা মঙ্গেশকরের কর্মজীবন:

তিনি যেহেতু সঙ্গীতজ্ঞ তাই গান গেয়েই সকলের মন জয় করেছেন আর এটাকে তিনি কর্মজীবন হিসেবেই বেছে নিয়েছেন। বোম্বাইয়ের ফিল্মস্থান কর্ণধার তৎকালীন এক মুভি মুঘল সশধর মুখার্জির কাছে সংগীত পরিচালক গোলাম হায়দারের হাত ধরে ১৫ বছর বয়সে কিশোরী লতা গিয়েছিলেন গান গাওয়ার সুযোগ পেতে ৪০ এর দশকের মাঝামাঝি  সময়ে।

সেদিন অসহায় পিতৃহারা কিশোরী লতাকে ফিরতে হয়েছিল শূন্য হাতে। ১৩ বছরের কিশোরী লতাকে একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার দেওয়ার সূত্রে হায়দার লতা কে চিনতেন আগে থেকেই। আর সেই কারণেই তিনি তাকে এই জায়গায় আনার জন্য চেষ্টা করেছেন।

গোলাম হায়দারের সংগীত পরিচালনায় লতার রেকর্ডিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তৎকালীন দিকপাল সংগীত পরিচালক হেমচন্দ্র প্রকাশ, নওশাদ এবং অনিল বিশ্বাস। এই তিনজনই লতার সুরেলা কণ্ঠস্বর এবং গায়কীয় স্বতঃস্ফূর্তিতে আকৃষ্ট হয়ে সুযোগ দিলেন নিজেদের সুরে গাওয়ার জন্য।

সংকর জয় কিষান “বরসাত” ছবিতে তার গান গাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। এরপর কাউকেই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রায় সকল সুরকারই বাঁধা পড়ে গেলেন লতা মঙ্গেশকরের এই সুন্দর কন্ঠের বেড়াজালে।

লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া কিছু সুপারহিট গান:

এক কথায় লতা মঙ্গেশকরের নাম শুনলেই গান শোনার আগ্রহটা যেন আরো বেশি বেড়ে ওঠে। ১৯৪৯ এ “জিয়া বেকারার হে” উতলা করে দিয়েছিল শ্রোতাদের মন ও প্রাণ, “মন দোলে মেরা তান দোলে” এই গানটি দুলিয়েছিল সারা দেশের হৃদয় কে। তারপর “আজারে পরদেশী” যা সকলের মুখে মুখে আজও গুনগুন করে ওঠে।

খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। ক্রমাগত সুপার-ডুপার হিট বহু গানের দৌলাতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে মাথায় করে তুলে রেখেছিল। সংগীত পরিচালকদেরও নয়নের মনি হয়ে উঠলেন তিনি।

গান গাওয়ার ভাব এবং সেই গানে নিজেকে আরও বেশি মিলিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সেই গানে যেন প্রাণ আসতো। একই ছবিতে তিনজন নায়িকার কন্ঠে গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর।

গাইবার ভঙ্গি প্রতিক্ষেত্রে কিন্তু পাল্টে নিয়েছিলেন। নার্গিসের মতো প্রায় পৌড় নায়িকার কন্ঠে যিনি মানানসই সেই লতার কন্ঠ অবলীলায় মিলে যায় “ববি” সিনেমার কিশোরী ডিম্পল এর সঙ্গেও।

এছাড়া শিশু কন্ঠের গান, বিরহের গান অথবা উচ্ছ্বাসের গান, শিশুকে ঘুম পাড়ানো মায়ের গান, প্রেমের গান, ভক্তিমূলক গান যাই হোক না কেন সিকুয়েন্সের সব পুরোপুরি নিজের মতো করে এবং বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন এই  কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর।

লতা মঙ্গেশকর নিজেকে ফিল্মি গানে এমন অপরিহার্য করে তুলেছিলেন যে সরকার জয় কিষান বলতেন, “লতাজির হাঁচি হলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সর্দি লেগে যায়।” হিন্দি সিনেমার গ্রেট শো ম্যান রাজ কাপুর বলেছেন, “আমরা সৌভাগ্যবান যে, লতার সময় ছবি করতে পেরেছি। এমন প্রতিভা শতাব্দীতে একজন জন্মায় কিনা সন্দেহ আছে।”

লতা মঙ্গেশকরের পুরস্কার ও সম্মান:

তিনি তার প্রতিভার জন্য পুরস্কার আর সম্মান পেয়েছেন অনেক। আকাশ ছোঁয়া খ্যাতির পথে হাঁটতে হাঁটতে অজস্র পুরস্কার সম্মানের মিছিল লতার দরজায় যেন হাজির হয়েছিল ভিড় জমাতে। তিনি এসবের যোগ্য ছিলেন আর এসব পেয়েছেন সকলের ভালোবাসায়।

কোলাপুর, খয়রাগড়, হায়দ্রাবাদ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট খেতাব (সম্মান সূচক), শংকরাচার্যের দেওয়া “স্বর ভারতী উপাধি”, ইলোক রঞ্জি প্রদত্ত রাষ্ট্রভূষণ তিরুপতি দেব স্থানমের দেওয়া “আস্থা বিদ্বান” খেতাব, ২৩ বার শ্রেষ্ঠ প্লে-ব্যাক সিঙ্গার পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি।

এছাড়া মধ্যপ্রদেশ সরকার দিয়েছেন “তানসেন পুরস্কার”। লতা মঙ্গেসকার কে ভারত সরকার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান “দাদাসাহেব ফালকে” পুরস্কার ও “পদ্মভূষণ” পুরস্কারে ভূষিত করেছেন।

লতা মঙ্গেশকরের রেকর্ড:

রেকর্ড অনুসারে ৩০ হাজারেরও অনেক বেশি গান গাওয়ার বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী হয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। বহু গান শিল্পী নিজের সংগ্রহতেই নেই। সম্পূর্ণ তালিকা উদ্ধার খুব কঠিন কাজ ছিল। ১৯৫৯ সালেই সপ্তাহে গড়ে ৩০ টি করে গান রেকর্ড করতে হয়েছে লতা মঙ্গেসকারকে।

একাত্তর সালের মধ্যে আঠারোশো সিনেমায় লতামঙ্গেসকার রেকর্ড করে ফেলেছেন প্রায় ২৫ হাজারের মতো গান। এমন অনেক গান যা গণনার বাইরেও রয়েছে, সেগুলিও তিনি তার স্বমহিমায় গেয়েছেন।

লতা মঙ্গেশকরের ভারতরত্ন পুরস্কার প্রাপ্তি:

তিনি বিভিন্ন পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি ভারতরত্ন পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন ২০০১ সালে। ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ভারতরত্ন পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন কোকিল কণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর।

তাছাড়া মধ্যপ্রদেশ সরকার ও মহারাষ্ট্র সরকার লতা মঙ্গেশকরের নামে চালু করেছেন লক্ষ্য টাকার পুরস্কার। জীবিত ব্যক্তির নামে এমন পুরস্কার ঘোষণার নজির সারা ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বে কোথাও নেই।

লতা মঙ্গেশকরের অবদান আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি আজ বর্তমানে আমাদের মধ্যে না থাকলেও তার গেয়ে যাওয়া গান গুলির মধ্যে থেকেই তিনি বেঁচে রয়েছেন সকলের মধ্যে।

লতা মঙ্গেসকারের মৃত্যু:

বয়স যতই হোক না কেন তার কোকিল কন্ঠি এই গানের সুর যেন কোনোভাবেই তার বার্ধক্যকে জানাতে দেয়নি বিশ্ববাসীকে। কোকিল কণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর ৯২ বছর বয়সে ২০২২ সালে ৬ ই ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ের ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সমাপ্তি ঘটে এক সুর সম্রাজ্ঞী কোকিল কন্ঠের সংগীত শিল্পীর। তবুও যেন তার গানগুলি যখনই বেজে ওঠে কোথাও, মনে হয় না যে তিনি আর আমাদের মধ্যেই নেই। অমর হয়ে রয়ে গেছেন সমস্ত গানের মধ্যে দিয়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top