লালা লাজপত রায় জীবনী 2023 – ইতিহাস, পরিবার এবং বিপ্লবী কার্যক্রম

লালা লাজপত রায় কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? লালা লাজপত রায় কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও লালা লাজপত রায়ের সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Lala Lajpat Rai in Bengali)।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক বীর বিপ্লবী সংগ্রাম করতে করতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। এমন বহু বিপ্লবীদের মধ্যে লালা লাজপত রায় হলেন একজন স্বাধীনতার সংগ্রামী। তিনি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক এবং লক্ষ্মী বীমা কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন। তাকে পাঞ্জাব কেশরী নামেও অনেকেই চেনেন।

লালা লাজপত রায় জীবন পরিচয় - Lala Lajpat Rai Biography in Bengali
লালা লাজপত রায় জীবন পরিচয় – Lala Lajpat Rai Biography in Bengali

এছাড়া তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চরমপন্থী দলের লাল – বাল – পালের অন্যতম নেতা। ১৯২৮ সালের সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জে গভীরভাবে আহত হন তিনি। কেননা তিনি তখন অনেকটাই বয়স্ক ছিলেন, আর সেই আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তো চলুন এমন এক দুঃসাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনী সম্পর্কে জানা যাক:

লালা লাজপত রায়ের জীবনী: 

  • সম্পূর্ণ নাম: লালা লাজপত রায়
  • ছদ্মনাম অথবা ডাকনাম: পাঞ্জাব কেশরী
  • জন্ম তারিখ: ২৮ শে জানুয়ারি ১৮৬৫ সাল
  • জন্মস্থান: ধুডিকে, লুধিয়ানা জেলা, পাঞ্জাব, ভারত
  • পিতার নাম: মুন্সী রাধা কৃষ্ণাণ আজাদ
  • মাতার নাম: গুলাব দেবী
  • মাতৃভাষা: হিন্দি
  • পড়াশোনা: লাহোর গভারমেন্ট কলেজ, ইউনিভার্সিটি অফ লাহোর গভর্মেন্ট, হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল Rewari
  • স্ত্রীর নাম: রাধা দেবী আগরওয়াল
  • কর্মজীবন: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, আর্য সমাজ।
  • সন্তান: প্রয়ারেলাল আগারওয়াল (ছেলে), পার্বতী আগারওয়াল (মেয়ে), অমৃত রায় আগারওয়াল (ছেলে)
  • ধর্ম: হিন্দু
  • জাতীয়তা: তিনি ভারতীয়
  • মৃত্যু: ১৭ ই নভেম্বর ১৯২৮, লাহোর, পাকিস্তান,
  • উল্লেখযোগ্য রচনাবলী: রাজা শিবাজী ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেছেন
  • বয়স: ৬৩ বছর।

লালা লাজপত রায়ের জন্ম এবং শৈশব জীবন: 

লালা লাজপত রায় পাঞ্জাবে ১৮৬৫ সালের ২৮ শে জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল রাধা কৃষ্ণান আজাদ। কিছু সময় কাল হরিয়ানার রহতাক এবং হিসাব শহরে তিনি ও কালতি করেছিলেন। সাথে তিনি লাল বাল পাল নামে বিখ্যাত ছিলেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি দেশের জন্য নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন।

লালা লাজপত রায় এর সমাজ সেবা: 

তিনি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর সাথে আর্য সমাজকে পাঞ্জাবে জনপ্রিয় করে তোলেন। এছাড়া অনেক জায়গায় দুর্ভিক্ষের সময় শিবির স্থাপন করে অসহায় মানুষদের সেবা করেছেন।

১৯২৮ সালের ৩০ শে অক্টোবর তিনি সায়মন কমিশনের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন আর সেখানে তিনি পুলিশের লাঠিচার্জে গভীরভাবে আহত হন। আহত অবস্থায় তিনি বলেছিলেন, “আমার শরীরে করা ব্রিটিশের প্রহার, ব্রিটিশের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবে।”

লালা লাজপত রায়ের হিন্দি সাহিত্যের সেবা: 

লালা লাজপত রায়, তিনি ছিলেন হিন্দিভাষী অর্থাৎ তার মাতৃভাষা ছিল হিন্দি আর সেই কারণে হিন্দি ভাষাতে মধ্যযুগীয় হিন্দুত্ববাদী রাজা শিবাজীভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেছিলেন।

এছাড়া তিনি ভারতে ও বিশেষ করে পাঞ্জাবে পাঞ্জাবী ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে হিন্দি ভাষা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ রূপে সহযোগিতা করেছিলেন।

লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর পরের বর্ণনা: 

পুলিশের লাঠির আঘাতে লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর ফলে সমগ্র দেশ তখন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরু ও অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীরা লালাজির মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা নেয়।

এরপর ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর এই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা লালার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্স কে গুলি করার হত্যা করেন, হত্যা করার জন্য রাজগুরু, সুখদেব, ভগৎ সিং কে ব্রিটিশ সরকারের জেল থেকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এইভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন সূচনার সৃষ্টি হয়।

লালা লাজপত রায়ের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যাক: 

  • অন্যান্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা দের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লালা লাজপত রায় ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। তখন তিনি অনেকটাই ছোট ছিলেন।
  • ১৮৮০ সালে তিনি লাহোরের সরকারি কলেজে আইন নিয়ে পড়তে চলে যান, আর এই সময়ে তিনি কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান।
  • ১৮৭৭ সালে তিনি রাধা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের তিন সন্তান ছিল, দুটি ছেলে এবং একটি মেয়ে।
  • ১৮৮৬ সালে তিনি এবং তার পরিবার হিসার তে চলে আসার পর সেখানে তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং প্র্যাকটিস করতে শুরু করেন। পরে তিনি হিসারে আইনজীবী বাবু চূড়ামণির সঙ্গে বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
  • যখন তিনি লাহোরে ছিলেন সেই সময় আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীকে দেখেন এবং তার শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে লালা লাজপত রায় আর্য সমাজে যোগদান করেন।
  • তাছাড়া তিনি ১৮৮৮ সাল এবং ১৮৮৯ সালে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেওয়া চারজন প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এছাড়া দুটি অধিবেশনই এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
  • লালা লাজপত রায় বাবুচূড়া মনির সঙ্গে হিসার জেলায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই একই জেলাতে আর্য সমাজের একটি শাখা ও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
  • তার পাশাপাশি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকলক্ষী বীমা কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন লালা লাজপত রায়। তার নির্দেশনাতে দয়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক বিদ্যালয় পরিচালক কমিটি ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • ১৮৯২ সালে তিনি লাহোর হাইকোর্টে আইন প্রাকটিস করতে যান। আর এই সময় তিনি সাংবাদিকতা নিয়েও প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং “দ্য ট্রিবিউন” পত্রিকাতে তিনি নিয়মিত ভাবে লিখতেন।
  • ১৯৬০ সালে মে মাসে পাঞ্জাবের রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ নেওয়ার জন্য তাকে বার্মার মান্দালয়ে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল।
  • তিনি এতটাই বুদ্ধিমান ছিলেন যে, শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিলেন তাকে আইন ত্যাগ করতে হবে এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে হবে। সেই মতো তিনি ১৯১৪ সালে আইন প্র্যাকটিস করা সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে দেন।
  • ১৯২৮ সালের ৩০ শে অক্টোবর তিনি সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জে গভীরভাবে আহত হন এবং মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।
  • ১৯২০ সালে অনুষ্ঠিত কলকাতা বিশেষ অধিবেশন চলাকালীন লালা লাজপত রায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের (INC) প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
  • লালা লাজপত রায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেকগুলি দুঃখজনক ঘটনার মধ্যে ১৯২৭ সালে তার মা যক্ষা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় তিনি তার মায়ের স্মৃতিতে গুলাব দেবী চেস্ট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস অনুসারে জানা যায় যে, যেখানে তার মা মারা গিয়েছিলেন হাসপাতালটিও পাকিস্তানের ওই একই জায়গায় অবস্থিত। ১৯৩৪ সালের ১৭ ই জুলাই সেই হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়। হাসপাতালটি কেবলমাত্র মহিলাদের দ্বারাই পরিচালিত।
  • লাঠি চার্জ এর পর তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থাতেও তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন নি এবং ১৯২৮ সালের ১৭ ই নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
  • ১৯৭৯ সালে লালা লাজপত রায় ট্রাস্টের উদ্বোধন করেন পাঞ্জাবের একদল সমাজসেবী।
  • তার পাশাপাশি ২০১০ সালে লালা লাজপত রায় পশু চিকিৎসা এবং প্রাণিবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে হরিয়ানা সরকার।

তিনি আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের লাঠিচার্জে গভীরভাবে আহত হন এবং যে স্যান্ডার্স কে হত্যা করার জন্য ভগত সিং, সুখদেব, রাজগুরু, বিপ্লবীরা গুলি চালিয়েছিলেন, সেটা ভুলবশত স্কট ছিল না আর সেই কারণে এই আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের উপরে লাঠিচার্জ করার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি স্কট নিজেই কিন্তু ওই লাঠিচার্জ এ গিয়ে আঘাত করেছিল লালা জী কে।  স্কট লালা লাজপত রায় কে মারাত্ম্যক ভাবে লাঞ্ছিত করেছিল আর সেই কারণেই হয়তো তিনি চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থাতেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

কথায় আছে বিপ্লবীরা প্রাণ দিতে রাজি আছে তবু দেশকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেবে না অথবা নিজের লাঞ্ছনা সহ্য করবে না অথবা দেশবাসীর লাঞ্ছনা সহ্য করবে না। সেই কারণে অনেক বিপ্লবী হাসতে হাসতে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।

তবে এমন সব বিপ্লবীদের মধ্যে প্রবীণ বিপ্লবী ছিলেন এই লালা লাজপত রায়। এছাড়া তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় সমাজের জন্য অনেক কল্যাণকর কাজ করে গিয়েছেন, তার নামে আজ হাসপাতাল, ট্রাস্ট চলছে। যেগুলি তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top