চার চাকা গাড়ির ইন্সুরেন্স নেওয়া কেন জরুরি? জেনে নিন

গত কয়েক দশকে আর্থিক দিক থেকে কিছুটা বদলে গেছে আমাদের দেশের মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা। মধ্যবিত্তের সঙ্গে চার চাকার দূরত্বটা এখন আর অলিক স্বপ্নের মত নয়। এখন অনেক মধ্যবিত্তরাই গাড়ি কিনছেন ।

কিন্তু গাড়ি কেনার পাশাপাশি গাড়ির ইন্স্যুরেন্সের বিষয়গুলিও কম গুরুত্বপূর্ন নয়, তাই মোটামুটিভাবে জেনে রাখতে হবে গাড়ির ইন্স্যুরেন্সের বিষয়গুলি। অতীতে বিভিন্ন সময় গাড়ি ইন্স্যুরেন্স নিয়ে আলোচনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সম্প্রতি এর বিধিতে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সে কারণেই আজ একবার পুরোটা ভালো করে বুঝে নেওয়া যাক।

চার চাকা গাড়ির ইন্সুরেন্স নেওয়া কেন জরুরি? জেনে নিন
চার চাকা গাড়ির ইন্সুরেন্স নেওয়া কেন জরুরি? জেনে নিন

আমাদের জীবন এক অনিশ্চিতায় ভরা। তাই ইন্স্যুরেন্সের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। লাইফ ইন্স্যুরেন্স কেউ করছেন, কেউবা করছেন না, কিন্তু গাড়ির ক্ষেত্রে অন্তত এই ধরনের ইন্স্যুরেন্স করা বাধ্যতামূলক। তাই গাড়ির ইন্স্যুরেন্স না করে সেই গাড়ি রাস্তাতেই নামানো যাবে না।

তবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কেনা গাড়ির ইন্স্যুরেন্সের সময়সীমায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। দেখুন আপনার চাহিদা ও প্রিমিয়াম অনুযায়ী গাড়ি ইন্স্যুরেন্স কি ধরেনের কভারেজ দিয়ে থাকে।

থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি কভারেজঃ Third Party Insurance

গাড়ি কিনলেই এই ইন্স্যুরেন্স করা বাধ্যতামূলক। ইন্স্যুরেন্স শিল্পের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘অ্যাক্ট ওনলি কভার’। গাড়ির ধাক্কায় অন্য কোনও গাড়ি বা সম্পত্তির ক্ষতি হতে পারে।, হতে পারে জখম কিংবা মৃত্যুও।

সে কথা মাথায় রেখেই এই ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট গাড়ি যার বা যে সম্পত্তির ক্ষতি করবে, তাঁকে বা সেই বস্তুকে আর্থিক সুরক্ষা দেবে এই ইন্স্যুরেন্স। ইন্স্যুরেন্সের প্রথম দু’টি পক্ষ ইন্স্যুরেন্সকারী ও ইন্স্যুরেন্স কম্পানী।

আর তৃতীয় পক্ষ হলেন যিনি বা যাঁর সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। তাই এর নাম থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি। মনে রাখবেন, আপনার গাড়ির ক্ষতিপূরণ দেওয়া এই ইন্স্যুরেন্সের কাজ নয়। কী ধরনের সুবিধা রয়েছে এই ইন্স্যুরেন্সে?

তৃতীয় পক্ষের ক্ষতিপূরণঃ

গাড়ির ধাক্কায় কেউ জখম হলে বা কারও মৃত্যু হলে সে ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্সের কোনও সীমা নেই। তবে অন্য কোনও গাড়ি বা সম্পত্তির ক্ষতি হলে ইন্স্যুরেন্সের (চারচাকা) ঊর্ধ্বসীমা ৭.৫০ লক্ষ টাকা

ইন্স্যুরেন্সকারী চাইলে অবশ্য তা ৬,০০০ টাকায় সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তার প্রিমিয়ামও কম হবে। তবে খেয়াল রাখবেন, ইন্স্যুরেন্স  সংস্থা তখন ওটুকু টাকাই দেবে। ক্ষতিপূরণের অঙ্ক তার চেয়ে বেশি হলে তা আপনাকে ভরতে হবে নিজের পকেট থেকেই।

ব্যক্তিগত সুরক্ষাঃ

যাঁর নামে গাড়ি, তাঁর নামেই ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলে প্রিমিয়ামের সঙ্গে অল্প কিছু টাকা যোগ করে বাড়তি একটি সুরক্ষা নেওয়া বাধ্যতামূলক। যেখানে দুর্ঘটনায় ইন্স্যুরেন্সকারীর ব্যক্তিগত ক্ষতি হলেও সুবিধা পাওয়া যাবে।

এ ক্ষেত্রে নতুন নিয়মে ইন্স্যুরেন্সের অঙ্ক হয়েছে ১৫ লক্ষ টাকা। ফলে প্রিমিয়ামও কিছুটা বেড়ে গেছে। আগে বাইকের ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্সর অঙ্ক ছিল ১ লক্ষ টাকা। চার চাকায় ছিলো ২ লক্ষ টাকা। তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখুন।

ধরা যাক স্বামীর ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু গাড়ি স্ত্রীয়ের নামে। তাঁর লাইসেন্স নেই। সে ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি কভারে মূল গাড়ি ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে এই বাড়তি সুবিধা স্ত্রী পাবেন না।

প্রিমিয়ামঃ

থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি কভারে প্রিমিয়ামের অঙ্ক নির্ভর করবে আপনার গাড়ির ধরনের উপরে। চার চাকার পাশাপাশি প্রিমিয়ামের হিসেব হবে গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষমতার বিচারে। নীচে সেই হিসেবে প্রিমিয়ামের শ্রেণিগুলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

চালকের জন্যঃ

একে বলে ওয়াইডার লিগাল লায়াবিলিটি। যেখানে বেতনভুক চালক ডিউটিতে থাকাকালীন দুর্ঘটনায় পড়ে শারীরিক ভাবে পঙ্গু হলে বা মারা গেলে ইন্স্যুরেন্সের টাকা মিলবে।

কর্মীর জন্যঃ

গাড়ি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত না হলেও, যদি তাতে চেপে ইন্স্যুরেন্সকারীর নিজস্ব ব্যবসা বা দফতরের কর্মী কোনও কাজে যান এবং গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে, তা হলে ওই কর্মীর জন্য ইন্স্যুরেন্সের সুবিধা পাওয়া যায়। ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায় ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।

যাত্রীর জন্যঃ

গাড়িতে চালক-সহ যে ক’জন যাত্রী চাপতে পারেন তাঁদের সকলের জন্য দুর্ঘটনা ইন্স্যুরেন্সের সুরক্ষা নেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে যাত্রী সংখ্যার ভিত্তিতে ইন্স্যুরেন্স করানো যেতে পারে। আবার তা করানো যায় পরিবারের যে সদস্যেরা চাপবেন তাঁদের নামেও।

কম্প্রিহেনসিভ পলিসি : Comprehensive Insurance

পুরো গাড়ির ক্ষতিপূরণঃ

ধরা যাক, নতুন গাড়ির দাম (শো-রুম থেকে কেনার সময়) ৫ লক্ষ টাকা। এই দামকে বলা হয় ইনশিওর্ড ডিক্লেয়ার্ড ভ্যালু (আইডিভি)। কেনার পরে প্রথম বছরেই পুরো গাড়ির কোনও ক্ষতি হলে বা হারালে দামের থেকে ৫% বাদ দিয়ে (ডেপ্রিসিয়েশন) গাড়ির ইন্স্যুরেন্স মূল্য ধরা হবে ৪.৭৫ লক্ষ টাকা। সে ক্ষেত্রে এই ইন্স্যুরেন্স মূল্য দাবি করতে পারবেন ইন্স্যুরেন্স কারী।

তার পরের বছর থেকে প্রতি বছর গাড়িটির বাজারমূল্য থেকে যথাক্রমে ২০%, ৩০%, ৪০% ও ৫০% করে বাদ দিয়ে ইন্স্যুরেন্স মূল্য ধরা হবে। গাড়িটি পাঁচ বছরের পুরনো হওয়ার পরে পুরো বাজার দরের হিসেবেই ধরা হবে ইন্স্যুরেন্স মূল্য। তবে তারপর আর কত দিন ইন্স্যুরেন্সেরসুবিধা নেওয়া যাবে তা নির্ভর করবে গাড়িটি অবস্থার উপর। যা মূল্যায়ন করবে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী।

আংশিক ক্ষতিপূরণঃ

গাড়ির আংশিক ক্ষতি হলে তা পূরণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন, দুর্ঘটনায় কাচ ভাঙলে তার পুরো খরচ পাওয়া যায়। রবার, এয়ারব্যাগ, টায়ার, ব্যাটারির মতো কিছু যন্ত্রাংশ মেরামতের ক্ষেত্রে মেলে মোট খরচ বা দামের ৫০%। বাকি ধাতব যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে গাড়ি কেনার ছ’মাসের মধ্যে ক্ষতি হলে কোনও ডেপ্রিসিয়েশন নেই।

তবে ছ’মাসের পর থেকে এক বছরের মধ্যে হলে খরচের ৫% বাদ দিয়ে বাকি টাকা পাওয়া যায়। দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে তা ঘটলে প্রতি বছর ডেপ্রিসিয়েশনের হার হবে আলাদা আলাদা। ১০ বছরের পরে মিলবে ৫০% ইন্স্যুরেন্স সুবিধা।

প্রিমিয়ামঃ

থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি কভারের মতোই গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষমতার নিরিখে ঠিক হবে প্রিমিয়ামের অঙ্ক। তবে সেই সঙ্গে তা নির্ভর করবে আরও কয়েকটি বিষয়ের উপর। দেখা হবে গাড়ির বয়স, দাম, কোন রিজিয়োনাল ট্রান্সপোর্ট অফিসে (আরটিও) সেটি নথিভুক্ত ইত্যাদি।

ব্যক্তিগত ক্ষতিপূরণঃ

আপনার গাড়ির ক্ষতি হলে তা পূরণের আশ্বাস দেয় কম্প্রিহেনসিভ প্রকল্প। কিন্তু দুর্ঘটনায় গাড়ির সওয়ারির শারীরিক অক্ষমতা বা মৃত্যুর মতো ব্যক্তিগত ক্ষতিকে ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনতে পারেন আপনি। এর আওতায় রয়েছেঃ

জিরো ডেপ্রিসিয়েশনঃ

এ ক্ষেত্রে ইনশিওর্ড ডিক্লেয়ার্ড ভ্যালু বা আইডিভি একই থাকবে। তবে গাড়ি কেনার পাঁচ বছর কেটে যাওয়ার পরে ষষ্ঠ বছর থেকে তা আর মিলবে না। কেউ যদি কেনার দু’বছর পরে গাড়ি বিক্রি করেন, তখন হাতফেরতা হলেও গাড়িটির ক্রেতা বাকি তিন বছরের জন্য এই সুবিধা পাবেন। আবার পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পরে বেচলে ক্রেতা সেই সুবিধা পাবেন না।

ইনভয়েস প্রোটেক্টঃ

ধরা যাক গাড়ির দাম ৫ লক্ষ টাকা। ইন্স্যুরেন্স মূল্য ৪.৭৫ লক্ষ। কিন্তু পুরো গাড়ির কোনও ক্ষতি হলে বা সেটি চুরি গেলে ফের নতুন গাড়ি কেনার দরকার হতে পারে। এই বাড়তি সুরক্ষাটি নেওয়া থাকলে সে ক্ষেত্রে আর্থিক সুরাহা হবে। গাড়িটির প্রথম বারের রেজিস্ট্রেশনের খরচ, ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম বাবদ খরচ, রোড ট্যাক্সবই ফেরত পাওয়া যাবে।

ইঞ্জিন প্রোটেক্টশনঃ

বৃষ্টির জল বা জমা জল ঢুকে ইঞ্জিনের ক্ষতি হতে পারে। সে সমস্যার বাড়তি সুরক্ষা কবচ এটি।

নো ক্লেম বোনাসঃ

যে বছর ইন্স্যুরেন্স  করা হবে, সেই বছর ক্ষতিপূরণ দাবি করা না-হলে পরের বছর বোনাসের সুবিধা মেলে। ২০% থেকে শুরু করে পরের বছরগুলিতে সর্বোচ্চ ৫০% ছাড় মেলে প্রিমিয়ামে।

তবে যে বছর ইন্স্যুরেন্সের দাবি করা হয়, তার পরের বছর তা মেলে না। দাবি জানানোর পরে ফের এই সুবিধা পাওয়ার শর্তও রয়েছে। এক সংস্থা থেকে অন্য সংস্থায় গাড়ি ইন্স্যুরেন্স  সরালেও প্রমাণপত্র দাখিল করে সুবিধা বজায় রাখা যায়।

এই সময়ে আমরা জানলাম চার চাকার গাড়ির ইন্স্যুরেন্সের নানা কথা। তাই বলা যায় আমাদের চার চাকার গাড়ি রাস্তায় চালাতে ইন্স্যুরেন্স খুবই গুরুত্বপূর্ন। এই ইন্স্যুরেন্স শুধু গাড়ির সুরক্ষা দেবেনা বরং গাড়ির চালক, যাত্রী, গাড়ি কারো ক্ষতি করলে তার ক্ষতিপূরনও দেবে। তাই আমাদের গাড়ি কেনার সাথে সাথেই একটি ভালো ইন্স্যুরেন্স পলিসি খুঁজে, ইন্স্যুরেন্স পলিসি গ্রহন করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top