বাঙালি দের সারা বছর ধরে পূজা পার্বণের শেষ নেই। তেমনি চৈত্র মাসের একেবারে শেষে চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার প্রচলন আজও সকলকে উৎসবের আমেজ দিয়ে থাকে।
এই উৎসব অনেক প্রাচীনকাল আগে থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে গ্রাম বাংলা থেকে বিভিন্ন জায়গায়। চৈত্র মাসের শেষ দিনে শুরু হয়ে এই উৎসব বৈশাখ মাসের প্রথম দুই তিন দিন ধরে চলে, যাকে চড়ক উৎসব ও বলা হয়।
এর পাশাপাশি শিব ঠাকুরের গাজন উৎসবের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে ধরা হয় এই উৎসবকে। এই দিন বিভিন্ন স্থানে মেলা তো বসে, তার সাথে সাথে চলে বিভিন্ন ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান।
এই পূজা সম্পর্কে অনেক অজানা রহস্য আজও অনেকেই হয়তো জানেন না, এর কিছু নিয়ম-রীতি রয়েছে যেগুলি খুবই যন্ত্রণাদায়ক। যা সাধারণ মানুষকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে থাকলেও তবুও এই প্রথা আজও সকলকে প্রভাবিত করে স্বর্গ লাভের আশায়।
সুচিপত্র
চড়ক পূজার ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানা যাক:
প্রতিটি পূজা পার্বণের উৎসব অনুষ্ঠান গুলি প্রাচীনকালে কোন না কোন সময় থেকে প্রচলিত ছিল। সেখান থেকে আজ সকলের পালন করার মধ্যে দিয়ে এবং বংশ পরম্পরায় প্রথা হিসেবে চলে আসছে।
এই পূজার কথা কোন পুরানে উল্লেখ তেমন ভাবে নেই, চৈত্র মাসে শিব ঠাকুরের আরাধনা নাচ গানের বিষয় এর তো উল্লেখ রয়েছে, তবে ইতিহাস অনুসারে জানা যায় যে, দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সঙ্গে শিবের একনিষ্ঠ উপাসক বাণ রাজার যুদ্ধ হয়।
সেই যুদ্ধে মহাদেবের থেকে অমরত্ব লাভ করার জন্য বাণ রাজা নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেছিলেন এবং ভক্তিমূলক নাচ গানও করেন। তখন থেকে এই পূজার শুরু।
তাই চড়ক পূজায় কিন্তু ভক্তদের মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য মহাদেবকে শান্ত করতে ও সন্তুষ্ট করতে নিজের শরীরের রক্ত দিতে হয়। অনেকেই এই হিসেবে মানত করে থাকেন যে, যদি কোন মনস্কামনা পূর্ণ হয় তাহলে শরীর থেকে রক্ত দিয়ে সেই পূজা সম্পন্ন করবেন।
বর্তমান সময়ে অনেকে মনে করেন যে ১৪৮৫ সালে রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুর প্রথম এই পুজোর প্রচলন করেন। সেই থেকে শৈব সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসব পালন করে আসছেন প্রাচীন কাল থেকে বলা যেতে পারে।
চড়ক পূজা ও গাজন সম্পর্কে এই অজানা তথ্য আপনি এখনো জানেন না
এই পূজার কিছু প্রথা ও রীতি:
প্রতিটি পূজা পার্বণে উপস্থিত দেব-দেবীদের সন্তুষ্ট করতে ভক্তগণ অনেক কিছুই করে থাকেন। তবে চড়ক পূজার কিছু প্রথা রয়েছে যেগুলি সত্যিই ভয়ংকর এবং দৈহিক যন্ত্রণাদায়ক।
এই সমস্ত কষ্ট উপভোগ করার মধ্যে দিয়ে তারা মনে করেন যে, খুব সহজে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করে স্বর্গ লাভ করা যাবে। এই পূজোর কিছু বিশেষ প্রথা রয়েছে, যা আজও খুবই ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে থাকেন গ্রাম বাংলার মানুষ জন ও ভক্তগণ।
যেমন ধরুন:-
১) জলন্ত কয়লার আগুন এর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া
২) ছুরি অথবা কাঁটার উপরে লাফানো,
৩) কুমিরের পুজো করা
৪) শিব ঠাকুরের বিয়ে দেওয়া
৫) আগুনের উপর নাচানাচি করা
৬) শরীরকে বাণ বিদ্ধ করে চড়ক গাছে ঝুলতে থাকা।
এই সমস্ত বিষয় গুলি শুনতে হয়তো অনেকটাই সহজ বলে মনে হচ্ছে, একবার ভেবে দেখুন এই সমস্ত বিষয় গুলি যদি কোন মানুষের উপরে হয়ে থাকে তাহলে তার কতটা কষ্ট হতে পারে।
এই চড়ক পূজোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো দৈহিক যন্ত্রণা, যত বেশি দৈহিক যন্ত্রণা দিতে পারবেন কোন ভক্ত, সেই ভক্ত কিন্তু তত বেশি মহাদেবের সন্তুষ্ট করার কাজে সফল হবে। এই দৈহিক যন্ত্রণাদায়ক বিষয়টি চড়ক পূজার একটি বিশেষ অঙ্গ বলে মনে করা হয়।
নর বলির সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত এই পূজার রীতি-নীতি:
দেব দেবীদের সন্তুষ্ট করতে নরবলি প্রথা যেমন একদিকে কিছু মানুষের কাছে আনন্দদায়ক তেমনি অন্য দিকে কারো পরিবারের শূন্যতা। কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, প্রাচীন কৌম সমাজে প্রচলিত নরবলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে এই পূজার প্রথা ও রীতি-নীতি।
অনেকেই হয়তো এই সমস্ত ভয়ংকর প্রথাগুলি মেনে চলার পর শারীরিক ভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এছাড়া এই পূজার সর্বমূলে রয়েছে ভূত-প্রেত এবং পুনর্জন্মের গাঁথা কাহিনী।
এই পূজার আরো অন্যান্য অঙ্গ হিসেবে ভক্ত সন্ন্যাসী এবং সাধুসন্তরা হুক বা বড় বড়শি দিয়ে নিজেদের চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুত বেগে ঘুরতে থাকেন। এর পাশাপাশি লোহার জ্বলন্ত শলাকা তাদের পায়ে, হাতে, শরীরের আরও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, পিঠে এমনকি জিহ্বাতেও প্রবেশ করানো হয়।
এই প্রথা ও রীতি গুলি এই উৎসবে আগত আরো সকল মানুষজনদের মনোরঞ্জনের বিষয় হয়ে দাঁড়াতো প্রাচীনকাল থেকে আজও। তবে যাদের উপরে এই প্রথাগুলি চলতো তাদের কতটা শারীরিক যন্ত্রণা হত তা তো বোঝাই যাচ্ছে।
ব্রিটিশ দের দ্বারা এই পূজার কিছু প্রথা বন্ধ করা হয়েছিল:
ভারতবর্ষের ব্রিটিশরা অনেকদিন পর্যন্ত তাদের শাসন চালিয়েছে। তখন ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করেছিল সকলের জন্য। সেই সময়ও চলত এমন ভয়ংকর রীতি নীতি। আর প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই প্রথা।
কিন্তু এই প্রথা গুলির মধ্যে এমন অনেক মানুষ কে কষ্ট দেওয়া নরবলির মতো এর পাশাপাশি শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে অসুস্থ করে দেওয়ার এই প্রথা গুলি অক্লান্তভাবে মেনে চলেন স্থানীয় মানুষ ও সাধুসন্তরা।
এটা কোনোভাবেই ব্রিটিশরা মেনে নিতে পারেনি। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে বিভিন্ন জায়গায় এই নিয়ম নীতি গুলির উপরে বিধি-নিষেধ জারি করেছিল।
তবে তবুও আজও এমন অনেক বিষয়ে আইন অনুমতি না দিলেও গ্রাম বাংলার এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষজন সেই সমস্ত প্রথা, নিয়ম, নীতিগুলি মেনে চলেন আজও ভক্তির সাথে নিষ্ঠার সাথে।
যতই ব্রিটিশরা এই আইন বন্ধ করে থাকুক না কেন, আজও চড়ক পূজায় এই সমস্ত প্রথা গুলি, রীতি গুলি সকলে খুবই সাড়ম্বরে মেনে চলেন।