বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ তো আমরা সকলেই জানি। তবে বাংলা ক্যালেন্ডারে যে বারো মাস রয়েছে তার মধ্যে কার্তিক মাস হল সবচেয়ে সমৃদ্ধ ময় মাস। এই কার্তিক মাস বিষ্ণু ও শিব ভক্তদের অনুকূল বলে মনে করা হয়। আর এই কারণেই বিষ্ণু ও শিবের মন্দিরে হাজার হাজার ভক্তদের সমাগম ঘটে থাকে এই কার্তিক মাসে। এই মাসে পূর্ণিমাতে কার্তিক নক্ষত্রটি চাঁদের সহচার্য এ থাকে বলে এই মাসের নাম কার্তিক।
আবার অন্য দিক থেকে দেখলে দেখা যায় শিবের পুত্রের নাম হল কার্তিক। তাই এই মাসে নিষ্ঠা ভরে কয়েকটি বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবাদিদেব মহাদেব ও মাতা গৌরী কে সন্তুষ্ট করার পাশাপাশি কার্তিক ঠাকুরকেও সন্তুষ্ট করা যায় এবং অনেক পাপ মোচন হয়ে পুণ্য অর্জন করা যায়।
সারা কার্তিক মাস জুড়ে প্রতিটি হিন্দু ধর্মাবলম্বী দের ঘরে ঘরে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ এবং তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালানো সবকিছু অনুষ্ঠিত হয় খুবই সাড়ম্বরে। কোন কোন জায়গায় নিয়ম মেনে চলে ভগবত গীতা পাঠ। সেই কারণে সম্পূর্ণ কার্তিক মাস জুড়ে মেনে চলুন এই সাধারণ নিয়ম গুলি। যার ফলে আপনি ঈশ্বরের কৃপা দৃষ্টি পাবেন আর সমস্ত মনের ইচ্ছা পূরণ হবে সহজেই।
এবার তাহলে জানা যাক সম্পূর্ন কার্তিক মাস জুড়ে আপনি কোন নিয়ম গুলি পালন করবেন:
সুচিপত্র
১) পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ দান:
বংশের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ দান করার রীতি চলে আসছে অনেক যুগ আগে থেকে। কার্তিক মাসের শুরুর প্রথম দিন থেকেই সন্ধেবেলা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ দান করতে হবে। সম্পূর্ণ কার্তিক মাস এই নিয়ম পালন করুন প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায়।
২) গরিব দুঃখী ব্যক্তিদের ফেরাবেন না:
কার্তিক মাস সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করার মাস। তাই এই মাসে যদি কোন গরীব দুঃখী ব্যক্তি আপনার কাছে সাহায্য চান, তাহলে তাকে কখনোই তিরস্কার করে তাড়িয়ে দেবেন না। আপনার সাধ্যমত তাকে দান করুন, প্রয়োজনে তাকে সাহায্য করুন যাতে সে তার প্রয়োজন মেটাতে পারে।
তবে মনে রাখতে হবে যে, দান মানেই তা সব সময় আর্থিক দান হতে হবে, এমনটা কিন্তু নয়। আপনার যেমন সাধ্য তেমন ভাবেই আপনি সেই ব্যক্তিকে দান করতে পারেন। সেটা চাল, ডাল হতে পারে অথবা কোন বস্ত্র অথবা তার প্রয়োজনীয় কোন জিনিসপত্র।
৩) ঘরবাড়ি রাখুন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন:
চারিদিকে মাঠ ঘাট সবুজ হয়ে গিয়েছে, শস্যশ্যামলা হয়ে উঠেছে এই পৃথিবী। এই কার্তিক মাস জুড়ে ঘরবাড়ির কোন অংশে যেন নোংরা আবর্জনা না জমা হয়ে থাকে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বজায় রাখতে হবে বাড়ির ভেতরে এবং বাড়ির বাইরে ও আনাচে কানাচে। সেই সঙ্গে বাড়ির প্রধান দরজার সামনে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ঘর থেকে কেউ বাইরে বেরোনোর আগে দরজার সামনের অংশ জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া শুভ বলে মনে করা হয়।
৪) ধনতেরাসে বাড়িতে আনুন কোন ধাতু:
কার্তিক মাসেই পড়ে ধনতেরাস। আর এটি দীপাবলি উৎসবের সাথে বিশেষভাবে জড়িত, তবে আপনার সাধ্যমত এই দিন যদি বাড়িতে কোন ধাতু কিনে আনেন তাহলে আপনার সংসারে অনেক খানি সমৃদ্ধি বজায় থাকবে, সেটা সোনা অথবা রুপা হতেই পারে, সেটা আপনার সাধ্যমত কিনতে পারেন।
৫) তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালান:
তুলসী গাছকে দেবী জ্ঞানী পূজা করা হয়। তেমনি তুলসী পাতা অনেক পূজায় ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে এই কার্তিক মাসে প্রতিটি দিন তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালানো একটি শুভ কাজ, যা কিনা প্রতিদিন সন্ধেতে এই কাজ সম্পন্ন করতে হয়।
বাড়ির সকল অমঙ্গল দূর হয়ে গিয়ে মঙ্গলময় হয়ে উঠবে বাড়ির প্রতিটি আনাচ কানাচ।
৬) শ্রীমৎ ভাগবত গীতা পাঠ:
কার্তিক মাসে এমন অনেক জায়গায় দেখা যায় শ্রীমৎ ভাগবত গীতা পাঠ হতে, সকলে হয়তো এই গীতা পাঠ নাও করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে দেখা যায় যেখানে গীতা পাঠ হয়, সেখানে সামনে অনেকেই বসে সেটি শ্রবণ করেন। সেটাও কিন্তু অনেকখানি পূণ্যের কাজ।
আপনি চাইলে আপনার সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে অথবা ফেলে রেখেও এমন গীতা পাঠ শুনতে পারেন। এর ফলে আপনার মনে আসবে অনেক খানি প্রশান্তি এবং শ্রীমৎ ভাগবত গীতা মানুষকে সকল জ্ঞান প্রদান করার পাশাপাশি সকলের জীবনে অনেক খানি পরিবর্তন ঘটায়।
৭) ১৪ রকম শাক খাওয়া:
কার্তিক মাসে পড়ে কালীপূজা, যা কিনা কৃষ্ণা চতুর্দশী তে অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীতে ১৪ রকমের শাক খাওয়া রীতি রয়েছে। যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে শাস্ত্র এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনেক গুনাগুন।
শরীরের ভালো হওয়ার সাথে সাথে শাস্ত্রের সাথে মিল রেখে এই ১৪ রকম শাক খাওয়ার রীতি আজ থেকে প্রায় অনেক বছর আগে থেকে চলে আসছে। তারপর ১৪ টি প্রদীপ জ্বালিয়ে মা কালীর আরাধনা করা হয়, আর মাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে আপনার মনের সকল ইচ্ছা পূরণ হবে খুব সহজেই।
৮) দান করুন:
দান ধ্যান অনেকখানি পূণ্যের কাজ। আপনি জীবনে যতখানি উপার্জন করেন, সঞ্চয় করেন তার মধ্যে থেকে কিছুটা পরিমাণ যদি আপনি দান করে থাকেন, সেটা কোন মন্দির অথবা ধর্মীয় কোন স্থানে বা কোন দুঃখী মানুষদের জন্য, সেটা আপনার অনেকখানি পূণ্যের কাজ হবে।
আর যদি সেই কাজ কার্তিক মাসে করে থাকেন আরো বেশি শুভ ফলাফল পাবেন। দান করলে কখনোই সম্পদের পরিমাণ কমে যায় না বরং তার পরিবর্তে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হয়ে আপনাকে আরও বেশি দুই হাত ভরে ঢেলে দেবেন।
⭐ প্রতিটি মাস যেমন এক একটি উৎসবের সাথে সম্পর্কিত, তেমনি কার্তিক মাস সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই সমস্ত বিষয়গুলোর জন্য। সারা জীবনের পাপের ক্ষয়, পুণ্য অর্জন, মনের প্রশান্তি এবং সকলের ভালো চাওয়ার মধ্যে থেকে এই কার্তিক মাস সকলের জীবনে হয়ে ওঠুক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির এক সুন্দর পন্থা।
সকলেই চাইবেন যে জীবনে সবকিছুই থাকুক, সব স্বপ্ন পূরণ হোক, তার জন্য আপনাকে এই কার্তিক মাসে মেনে চলতে হবে এই নিয়মগুলি, যার ফলে খুব সহজেই আপনি ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করে মনের সকল ইচ্ছা পূরণ করতে পারবেন।