যদি কারো যৌতুকের কারণে মৃত্যু হলে কি করবেন? এই অপরাধের জন্য কি শাস্তি দেওয়া হয়? যৌতুকের কারণে মৃত্যু ও ওই মৃত্যুর জন্য দায়ি অপরাধীর বিরুধ্যে আইনি নিয়ম ও মামলার পদ্ধতি জানুন।
আমাদের সমাজে যৌতুক এমন একটি অভিশাপ, যে অভিশাপ এর ফলে অনেক নিরীহ মেয়েদের জীবন অকালে ঝরে যায়। তাছাড়া যারা বেঁচে থাকেন তাদের উপরেই যৌতুক নিয়ে বেশকিছু অত্যাচার করা হয়। তবে সবক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি হয় না।
তবে যারা যৌতুক নেওয়ার দিক থেকে মেয়েদের পরিবারকে বাধ্য করে থাকেন সেই পরিস্থিতিতে কিন্তু এমনটা হতে পারে। যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে কিছু সময় পর পর আন্দোলন হয়। তবে সেই আন্দোলনের ফলে কিছুদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও আবার সেই আগের প্রথায় ফিরে যায় সাধারণ মানুষ।
ঘরোয়া অত্যাচার / নিষ্ঠুরতা অধিনিয়ম, যৌতুক প্রতিরোধ অধিনিয়ম ইত্যাদি অধিনিয়ম তৈরি করে ভারতের সংসদে যৌতুকের অভিশাপ থেকে মহিলাদের সংরক্ষণের সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা করা হয়।
সুচিপত্র
যৌতুক মৃত্যু:
যৌতুক সম্বন্ধিত অপরাধের মধ্যে যৌতুক মৃত্যু সবথেকে জঘন্য অপরাধ বলা যায়। যেখানে যৌতুকের চাহিদা পূরণের জন্য পরিনাম স্বরূপ একটি হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়। আর ভারতীয় সমাজের জন্য এটি একটি গুরুতর সমস্যা বলা যেতে পারে।
আর এর গুরুতর সমস্যার সমাধান করার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধি এর অধীনে সম্পূর্ণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ভারতীয় দণ্ড সংহিতা ধারা 304 (b) যৌতুক মৃত্যুর সম্বন্ধিত আইন রয়েছে।
ভারতীয় দণ্ড সংহিতা ধারা চাষ 304 (b) অনুসারে যৌতুক মৃত্যুর পরিভাষা:
যেখানে কোন স্ত্রী অথবা কোন মহিলার মৃত্যু কোন রকম আঘাত এবং শারীরিক ক্ষতির দ্বারা করা হয়ে থাকে অথবা তার বিবাহের সাত (৭) বছরের মধ্যে সামান্য পরিস্থিতি থেকে অন্যথা অর্থাৎ অস্বাভাবিক ভাবে যদি তার মৃত্যু হয়ে যায় তাহলে এটা মনে করা হয় যে, অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুর কারণ হল এই মৃত্যুর আগে তার স্বামী অথবা স্বামীর পরিবারের আরো অন্যান্য সদস্যের সাথে যৌতুক সম্বন্ধিত কোন ঝামেলা হয়েছিল।
সেই সম্বন্ধে তার সাথে নিষ্ঠুরতা এবং অত্যাচার করা হয়েছে। আর সেই কারণে যদি সেই মহিলার অথবা স্ত্রীর মৃত্যু হয়ে থাকে, তাহলে তাকে যৌতুক মৃত্যু বলা যেতে পারে। আর এমন পরিস্থিতিতে সেই মহিলার স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য তার মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।
যৌতুক মৃত্যুর জন্য প্রয়োজনীয় কথা:
ধারা 304 (b) এর অন্তর্গত যৌতুক মৃত্যুর অপরাধ এর গঠনের জন্য মুখ্য রূপে দুটি বিষয় অবশ্যই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
১) যৌতুকের চাহিদা রাখা এবং সেই চাহিদা অনুসারে যৌতুক চাওয়া।
২) এই যৌতুকের চাহিদা নিয়ে স্ত্রীর মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে তাকে নির্যাতন করা।
কোন অভিযুক্ত সম্বন্ধে যখন এই দুটি কথা প্রমাণিত হয় তখন যৌতুক মৃত্যুর অপরাধের জন্য সেই ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এই দুটি কথা প্রমাণিত হওয়ার আধার এর উপর যৌতুক মৃত্যুর মতো জঘন্য অপরাধের অন্তর্গত অভিযুক্তকে দণ্ডিত করা হয়।
যদি কোন মামলাতে যৌতুকের চাহিদার সম্পর্কে কোনো রকম সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকে, তাহলে তাকে ধারা 304 (b) এর অন্তর্গত ঘোষিত করা হবে না। এই বিষয়টি স্টেট অফ উত্তরপ্রদেশ বনাম মহেশচন্দ্র পান্ডে এ আই আর (AIR) 2000 এস সি (SC) 3631 এর মামলাতে বলা হয়েছে।
বকশিশ রাম বনাম স্টেট অফ পাঞ্জাব এ আই আর 2013 এস সি 1484 এর মামলাতে যৌতুক মৃত্যুর জন্য সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা নিম্নলিখিত তথ্যগুলি অবশ্যই প্রয়োজনীয় মনে করা হয়।
অপ্রাকৃতিক মৃত্যুর সাক্ষ্য:
মৃত্যুর সঠিক আগের মুহূর্তে যৌতুকের চাহিদা নিয়ে কোন স্ত্রীকে বিরক্ত করার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রমাণ।
কাশ্মীর কৌর বনাম স্টেট অফ পাঞ্জাব এ আই আর 2013 এস সি 1039 এর মামলাতে সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা যৌতুক মৃত্যুর নির্মাণের কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলা হয়েছে।
১) যৌতুকের চাহিদা নিয়ে মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে মৃত মহিলার উপরে অত্যাচার করা এবং তাকে বিরক্ত করা।
২) মৃত মহিলার মৃত্যু আগুনে পোড়া অথবা কোনো শারীরিক ক্ষতি থেকে অপ্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে যদি হয়ে থাকে।
৩) এমন মৃত্যু বিবাহের সাত (৭) বছরের মধ্যে হতে পারে।
৪) মৃত মহিলার কষ্ট, তার সাথে নিষ্ঠুরতাপূর্ণ ব্যবহার অথবা তাকে বিরক্ত করা এই সমস্ত কাজ গুলি যদি সেই মহিলার স্বামী অথবা স্বামীর পরিবারের আরো অন্যান্য সদস্য দ্বারা করা হয়।
৫) এই সমস্ত কিছু শুধুমাত্র যৌতুক এর চাহিদা নিয়ে হওয়া জরুরী, এমন কেস এর জন্য।
৬) মৃত্যুর ঠিক আগে যন্ত্রণা এবং কষ্ট দেওয়া অথবা বিরক্ত করা।
যৌতুক কি?
যৌতুকের অর্থ ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা 304 (b) এর অন্তর্গত যৌতুকের পরিভাষা কোনোভাবেই ব্যক্ত করা হয়নি। কিন্তু ভারতীয় যৌতুক প্রতিরোধ অধিনিয়ম 1961 তে যৌতুকের পরিভাষা দেওয়া হয়েছে। সেই যৌতুক এই ধারার অন্তর্গত মনে করা হয়। এই কথা স্টেট অফ অন্ধপ্রদেশ বনাম রাজগোপাল আসাবা এ আই আর 2004 এস সি 1933 এর মামলাতে বলা হয়েছে।
আশেপাশের বয়ান অনুসারে জানা যেতে পারে যে, সেই গৃহবধূর সাথে কেমন ব্যবহার করা হত তার স্বামীর পরিবারে, যেমন বলা যায় যৌতুক নিয়ে সেই গৃহবধূর উপরে সব সময় শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করা হতো কিনা এমন বিষয় জানা গেলে মৃত গৃহবধূর স্বামী এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে আইন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
ধারা 304 (b) এর অন্তর্গত দন্ড / শাস্তি:
ধারা 304 (b) এর অন্তর্গত ন্যূনতম সাত বছরের কারাবাস আর আজীবন কারাবাস পর্যন্ত এই শাস্তি রাখা হয়েছে। তার সাথে সাথে জরিমানার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আর এই অপরাধ এর জন্য বিনা জামিনের অপরাধ মনে করা হয়। যেটা সত্য বিচারালয় দ্বারা বিচরণ করা হয়ে থাকে।
যৌতুকের কারণে কোনো গৃহবধূকে হত্যা করা, তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা, সবকিছু এক জঘন্যতম অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি তার স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পাওয়াটা জরুরী।
কারণ এমন অপরাধ যা কিনা যেখানে যৌতুক নেওয়া এবং দেওয়া অপরাধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা যেতে পারে, সেখানে এই যৌতুক নিয়ে কোন মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া গুরুতর শাস্তির যোগ্য অপরাধ হয়ে থাকে। এর জন্য আইন অনেক রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এখনো সমাজে এমন অপরাধ প্রায় ঘটেই চলেছে।
আইন যতই কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করুক না কেন, সমাজের মানুষ যদি পরিবর্তন না হয়, এমন অপরাধ থেকে বিরত যদি না থাকেন, তাহলে এমন যৌতুক মৃত্যু বন্ধ করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।