দীনেশ গুপ্ত কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? দীনেশ গুপ্ত কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও দীনেশ গুপ্তর সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Dinesh Gupta in Bengali)।
দীনেশচন্দ্র গুপ্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী একজন খুবই স্বনামধন্য বাঙালি বিপ্লবী। তিনি দীনেশ গুপ্ত নামেই বেশিরভাগ পরিচিত তিনি ঢাকা ও মেদিনীপুরে বিপ্লবী সংগঠন করে তুলেছিলেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনে বিনয়, বাদল, দীনেশ এই নাম সকলেরই জানা। আর এই তিনজন তরুণ বিপ্লবীর মধ্যে ছিলেন দীনেশ গুপ্ত।
সুচিপত্র
তরুণ বিপ্লবী এই দীনেশ গুপ্ত সম্পর্কে কিছু জানা যাক:
- সম্পূর্ণ নাম: দীনেশচন্দ্র গুপ্ত
- জন্ম: ৬ ডিসেম্বর ১৯১১ সাল
- জন্মস্থান: যশোলাং, বিক্রমপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে বাংলাদেশ)
- পিতার নাম: সতীশ চন্দ্র গুপ্ত
- মাতার নাম: বিনোদিনী দেবী
- মাতৃশিক্ষায়তন: ঢাকা কলেজ
- পরিচিতির কারণ: রাইটার্স বিল্ডিং এ অলিন্দ যুদ্ধ অথবা রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ
- মৃত্যুর কারণ: ফাঁসি
- মৃত্যু: ৭ জুলাই ১৯৩১ সাল (যখন বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর) কলকাতা বেঙ্গল প্রেসিডেন্স, ভারত (বর্তমানে ভারত)
১৯৩০ সালের ৮ই ডিসেম্বর বিপ্লবী বিনয় বসুর নেতৃত্বে দীনেশ গুপ্ত এবং বাদল গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং (বর্তমানে মহাকরণ) ভবনে অভিযান চালিয়েছিলেন। বিভাগের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসন কে হত্যা করেছিলেন।
পুলিশের সঙ্গে তাদের গুলি যুদ্ধ শুরু হয়, তাঁরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। দুই বিপ্লবী আত্মহত্যা করতে সমর্থ হলেও মৃতপ্রায় দীনেশকে পুলিশ বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। আর বিচারের তার ফাঁসির আদেশ হয়।
তবে মৃত্যুর আগে জেলে বসে তিনি অনেক খানি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠি গুলি ভারতের বিপ্লবী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং সাহিত্যিক বিচারেও অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে করা হয়। স্বাধীনতার পর তার এবং তার অপর দুই বিপ্লবী সঙ্গীর নাম অনুসারে কলকাতার প্রসিদ্ধ ডালহৌসের নাম রাখা হয়েছে বিনয় – বাদল – দিনেশ – বাগ সংক্ষেপে যেটা আমরা বি-বা-দী-বাদ বলে থাকি।
দীনেশ গুপ্তর শৈশবকাল ও শিক্ষাজীবন:
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের জন্ম হয়েছিল ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার যশোলং এ, যেটা বর্তমানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সিগঞ্জ জেলা। দীনেশ গুপ্তের পিতার নাম সতীশ চন্দ্র গুপ্ত মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। দীনেশ গুপ্তের ডাক নাম ছিল নসু। তাঁরা চার ভাই এবং চার বোনের মধ্যে দীনেশ গুপ্ত ছিলেন বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। দীনেশ গুপ্তর পিতা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী।
চাকরি-সুত্র তে তিনি কিছুকাল গৌরীপুরে থাকতেন। গৌরীপুরের পাঠশালাতেই দীনেশের প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ হয়। পরবর্তীতে নয় বছর বয়সে ভর্তি করা হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। প্রথম থেকে দীনেশ গুপ্ত ঢাকার গেন্ডারিয়া অঞ্চলে দাদুর বাড়িতে থাকতেন।
পরবর্তীতে উয়াড়িতে পৈত্রিক বাসভবনে চলে আসেন। ছোটবেলা থেকেই দীনেশ গুপ্ত ছিলেন খুবই নির্ভীক বেপরোয়া এবং তার মধ্যে ছিল অদম্য উৎসাহি। এই সময় থেকেই তার মনে স্বদেশ চেতনা এবং ব্রিটিশ বিরোধিতার আদর্শ তৈরি হয়েছিল।
দীনেশ গুপ্তর বিপ্লবী জীবনের সূচনা:
কিশোর বয়সে দীনেশ গুপ্ত বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য হন। ১৯২৬ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করার পর তিনি মেদিনীপুরে কর্মরত তার বড় দাদা যতিশ চন্দ্র গুপ্তের কাছে বেড়াতে আসেন।
এই সময় থেকে মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার সুপ্ত বাসনা তার মনে জেগে ওঠে। কিন্তু অন্যদিকে দেখা যায় দলের নির্দেশে সেবারে তাঁকে ঢাকায় ফিরে আসতে হয়েছিল বলে তিনি মেদিনীপুরে বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারেন নি।
এরপর ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আই এস সি (ISC Exam) পরীক্ষা দেন। কিন্তু এই পরীক্ষাতে তিনি কৃতকার্য হতে পারেন নি। এরপর তিনি মেদিনীপুরে গিয়ে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। দলের তরফ থেকে মেদিনীপুরের বেঙ্গল ভলেন্টিয়ারস শাখা স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেদিনীপুরে এসে দল সংগঠন এবং সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি তিনি তার পড়াশোনা ও চালিয়ে যেতে থাকেন।
যখন তিনি পড়াশোনা করছিলেন, ঢাকা কলেজে পড়ার সময় ১৯২৮ সালে দীনেশ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা সেশনের প্রাক্কালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস সংঘটিত বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এ যোগদান করেন। খুব তাড়াতাড়ি বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স একটি সক্রিয় বিপ্লবী সংগঠনের পরিবর্তিত হয় এবং কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়।
বিপ্লবীদের অস্ত্রবিদ্যা শেখানোর জন্য দীনেশ গুপ্ত কিছু সময় মেদিনীপুরেও ছিলেন। তার প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরা ডগলাস, বার্জ এবং পেডি এই তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পরপর হত্যা করেছিলেন।
রাইটার্স বিল্ডিং অথবা রাইটার্স ভবনে হামলা:
যে বয়সে বর্তমানে ছেলে মেয়েরা জীবনে অনেক কিছু স্বপ্ন দেখে থাকে, কিন্তু তখন এমন তরুণ বিপ্লবীদের মনে খুবই অল্প বয়সে দেশ স্বাধীন করার চেতনা জেগে উঠেছিল। তারা তাদের জীবনকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে যেতে একটুও ভয় পাননি। সংগঠনটি জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন এস সিম্পসন কে টার্গেট করেছিল। যে কিনা জেলখানার বন্দিদের উপরে অমানবিক নির্যাতন, অত্যাচার করার জন্য কুখ্যাত ছিল।
তারা শুধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে শুধুমাত্র সিম্পসন কে হত্যা করে তারা থেমে থাকবেন না, বরং কলকাতার ডালহাউসি স্কয়ারে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয় রাইডার্স বিল্ডিং অথবা রাইটার্স ভবনে আক্রমণ করে ব্রিটিশ অফিস পাড়ায় ত্রাস সৃষ্টি করবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯১৩ সালের ৮ ই ডিসেম্বর দিনেশ এবং তার দুই বিপ্লবী সঙ্গী বিনয় বসু এবং বাদল গুপ্ত সহ ইউরোপীয় পোশাকে রাইটার্স বিল্ডিং এ প্রবেশ করেন এবং সিম্পসন কে গুলি করে হত্যা করেন।
ব্রিটিশ পুলিশ গুলি শুরু করে দেয়, যার ফলে এই তিন তরুণ বিপ্লবীর সাথে পুলিশের গুলি যুদ্ধ শুরু হয়। পুলিশ দ্রুতই তাদের পরাজিত করে ফেলে, কিন্তু এই তিনজনের গ্রেপ্তার হওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। বাদল গুপ্ত ঘটনাস্থলে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিয়েছিলেন সেই কারণে ঘটনাস্থলেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আবার অন্যদিকে বিনয় এবং দীনেশ নিজেদের রিভলভার দিয়ে নিজেদেরকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। বিনয়কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩০ সালের ১৩ ই ডিসেম্বর। কিন্তু মৃতপ্রায় দিনেশকে বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল পুলিশ।
দীনেশ গুপ্তর বিচার এবং ফাঁসি:
কতটা নির্মম অত্যাচার করলে তবে এমনটা করা যায়, সেটা সত্যিই ধারণা করা অসম্ভব। মৃতপ্রায় মানুষকে বাঁচিয়ে তুলে তাকে আবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সত্যিই কি নির্মম, তাই না ! দীনেশ গুপ্ত কোনো রকমে এই চরম আঘাত থেকে বেঁচে ওঠেন, তাকে পুলিশ জীবিত করে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিল।
তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং বিচারের রায় দেওয়া হয় যে, সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড করার জন্য এবং খুনের জন্য ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু অর্থাৎ তাঁর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই আলিপুর জেলে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর।
শুধুমাত্র দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য তাজা তাজা প্রাণ গুলো অকালে ঝরে গিয়েছে। বাংলা সহ ভারতের অন্যান্য অংশে বিনয় বাদল এবং দীনেশকে শহীদ হিসেবে সম্মান করা হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে বিনয় বদল দীনেশের নাম অনুসারে কলকাতার ডালহৌসের স্কয়ারের নাম পাল্টে রাখা হয় বি-বা-দী-বাগ।
আজ বর্তমানে ভারত স্বাধীন, স্বাধীনতা দিবসে তাদেরকে স্মরণ করলে সত্যিই মনে হয় যে, এই স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। সবার মনের মনিকোঠায় তারা উজ্জ্বল প্রদীপের মতো জ্বলজ্বল করছেন। মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে রয়ে গিয়েছেন আমাদের মাঝে, দেশের জন্য আত্মবিসর্জন দেওয়ার পরও।