চাইল্ড কাস্টডি কি? চাইল্ড কাস্টডি কিভাবে পাওয়া যায়? ডিভোর্সের পর চাইল্ড কাস্টডি নিয়ে কিভাবে আবেদন করতে হয়? জানুন এই নিয়ে আইনি নয়ম কানুন ও নিষেধ করার কারণ।
চাইল্ড কাস্টডি বিবাহ বিচ্ছেদের পর তবেই মামলা দায়ের করা যেতে পারে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মধ্যে দিয়ে বিচারালয় এটি সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, বাচ্চার হেফাজত কিভাবে হতে পারে।
ব্যক্তিগত আইন-কানুন অনুসারে হেফাজত পাওয়ার জন্য আইন-কানুন আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। কিন্তু এই চাইল্ড কাস্টডি, এর পিছনে মুখ্য উদ্দেশ্য হল একটি, আর সেটা হল সেই বাচ্চার কল্যাণ অথবা সেই বাচ্চার ভালো করা।
অনেকবার যদি বিচারালয় এর এটা মনে হতে পারে যে, সেই বাচ্চার ভালোর জন্য তার হেফাযত বাবা-মায়ের মধ্যে কোন একজনকে না দিয়ে কোন অন্য তৃতীয় ব্যক্তিকে দেওয়া যেতে পারে।
সুচিপত্র
- মিউচুয়াল ডিভোর্স এর ক্ষেত্রে চাইল্ড কাস্টডি:
- বিবাদজনিত কারনে ডিভোর্স এর ক্ষেত্রে চাইল্ড কাস্টডি:
- বিচারালয় সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নিম্নলিখিত বিষয়ের উপরে বিচার করে থাকে:
- চাইল্ড কাস্টডি থেকে নিষেধ করার কারণ:
- চাইল্ড কাস্টডির জন্য ফাইল করার ক্ষেত্রে কি কি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?
- চাইল্ড কাস্টডি এর জন্য ফাইল কোথায় করবেন?
- কোন ব্যক্তি এমন ফাইল করতে পারেন?
- চাইল্ড কাস্টডির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুলো কি?
- হিন্দু আইন কানুন অনুসারে চাইল্ড কাস্টডি:
- মুসলিম আইন কানুন অনুসারে চাইল্ড কাস্টডি:
- খ্রিস্টান আইন-কানুন অনুসারে চাইল্ড কাস্টডি:
- বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ এর পর বাচ্চার সম্পত্তির অধিকার আছে কি?
মিউচুয়াল ডিভোর্স এর ক্ষেত্রে চাইল্ড কাস্টডি:
যখন দুই পক্ষই বিবাহ বিচ্ছেদের মামলাতে সহমত জানিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে বাবা-মাকে সেই বাচ্চার সম্পর্কে হেফাজতের কথা দুজনের মধ্যে বলতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদেরকে, এটা নির্বাচন করতে হবে যে, সেই বাচ্চার ভালোর জন্য কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
বাচ্চা লালন পালন এবং তাদের কার্যক্রম, ছুটি পাওয়ার সময় ইত্যাদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদেরকে বাচ্চার সর্বোত্তম ভালো সিদ্ধান্ত চিন্তা ভাবনা করতে হবে। বাবা-মায়ের মধ্যে বোঝাপড়া যেন সেই বাচ্চার কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে।
বিবাদজনিত কারনে ডিভোর্স এর ক্ষেত্রে চাইল্ড কাস্টডি:
যখন কোন বিবাহ বিচ্ছেদ কোন ঝগড়া ঝামেলার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে, তাহলে বাচ্চার ভালোর জন্যই যেটা সম্ভব সেটাই কিন্তু বিচারালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে বিচারালয় প্রত্যেক মামলার পরিস্থিতি আর বাচ্চার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সেই বাচ্চার কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
বিচারালয় সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নিম্নলিখিত বিষয়ের উপরে বিচার করে থাকে:
১) যেখানে নিজস্ব আইন কানুন অনুসারে নাবালক বাচ্চার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
২) নাবালকের বয়স, লিঙ্গ এবং ধর্ম।
৩) নাবালিকা প্রস্তাবিত অভিভাবকের চরিত্র এবং ক্ষমতা আর অন্যান্য সমস্যার সমাধান।
৪) বাচ্চার মৃত বাবা মায়ের কোনো ইচ্ছা আর নাবালক অথবা তার সম্পত্তির সাথে প্রস্তাবিত অভিভাবকের কোনরকম আগের সম্বন্ধ।
৫) যদি নাবালক নিজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে বিচারালয় তার উপর নির্ভর করে বিচার করতে পারেন।
৬) বিচারালয় যে কোন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অভিভাবক নিযুক্ত অথবা ঘোষিত করতে পারবে না।
৭) বিচারালয় সমস্ত বাচ্চা কে একসাথে রাখাটা সঠিক হিসেবে মনে করে থাকে। যদি কাস্টডির জন্য দুইজন অথবা তার অধিক ভাই-বোন শামিল হয়ে থাকে তো।
৮) বাচ্চার আরাম, স্বাস্থ্য, বৌদ্ধিক, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক কল্যাণের দিকে খেয়াল রেখে সমস্ত রকম বিষয়গুলো বিবেচনা করে তবেই কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
চাইল্ড কাস্টডি থেকে নিষেধ করার কারণ:
বিবাহ বিচ্ছেদে বাবা-মা একে অপরকে বাচ্চার হেফাজতের মূল্যায়ন এর অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। তাছাড়া এটি বিচারালয়ের বিবেকের উপর নির্ভর করে থাকে। যে বাচ্চার সব থেকে ভালো হওয়ার জন্য অথবা বাচ্চার ভালোর জন্য হেফাজতের কিছু অধিকার বাবা-মায়ের থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়ে থাকে।
এমন বিভিন্ন কারণ আছে, যার মাধ্যমে আদালত চাইল্ড কাস্টডি এর জন্য নিষেধ করে থাকে অথবা অস্বীকার করে থাকে উদাহরণ স্বরূপ নিচে দেওয়া হল:-
১) বিনা সংরক্ষক বাবা-মা বাচ্চার দেখভাল করে না বললেই চলে।
২) নেশা জনিত ওষুধ অথবা মদ এবং নেশা জাতীয় দ্রব্যের দুর্ব্যবহার।
৩) শিশু শোষণ
৪) বাচ্চাকে বন্দি করে রাখা।
৫) হিংসাত্মক মানসিক রোগ।
৬) বাচ্চাদের / শিশু দের ইচ্ছা।
চাইল্ড কাস্টডির জন্য ফাইল করার ক্ষেত্রে কি কি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?
১) এটি বিবাহবিচ্ছেদের সময়কালে অথবা পরবর্তীতে আইন হিসাবে মামলা দায়ের করা যেতে পারে।
৩) হেফাজতের জন্য যোগ্য হতে গেলে বাচ্চার বয়স ১৮ বছরের কম হতে হবে।
৪) হেফাজতের জন্য পাগল কোন বাচ্চা অথবা শিশুকেও দেওয়া যেতে পারে।
৫) চাইল্ড কাস্টডি অথবা হেফাজতের জন্য আইনি অধিকার হওয়া জরুরী।
চাইল্ড কাস্টডি এর জন্য ফাইল কোথায় করবেন?
সংরক্ষক আর ওয়ার্ড অধিনিয়ম 1890 এর সেকশন 9 অনুসারে একজন নাবালক ব্যাক্তি এর সংরক্ষক সম্বন্ধিত আবেদন সেই জেলা আদালতে দায়ের করা যাবে। যার মধ্যে নাবালকের ঘরও বিচারালয়ের অধিকারের ক্ষেত্রে আসে।
কোন ব্যক্তি এমন ফাইল করতে পারেন?
চাইল্ড কাস্টডির জন্য বিভিন্ন আইন কানুন আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। যেমন ধরুন হিন্দু আর খ্রিস্টান আইন কানুন:
- বাবা
- মা
- দাদু – দিদা
- ঠাকুরদা – ঠাকুরমা
মুসলিম আইন কানুন অনুসারে:
- বাবা
- মা
- বাবা মা ছাড়া অন্য কোনো অভিভাবক যিনি বাচ্চার হেফাজতের জন্য দাবি করতে পারেন।
- নিকটতম পিতৃগন
- নিজের ভাই
- একই পরিবারের অন্য ভাই
- নিজের ভাইয়ের ছেলে
- একই পরিবারের ভাইয়ের ছেলে
- বাবার নিজের ভাই
- বাবার পরিবারের অন্য কোন ভাই
- বাবার নিজের ভাইয়ের ছেলে
- দিদা
- দিদার মা
- মামি
- নিজের বোন
- একই পরিবারের অন্য কোন বোন
- সৎ বোন এবং
- বাবার পরিবারের সম্পর্কে কাকিমা।
চাইল্ড কাস্টডির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুলো কি?
চাইল্ড কাস্টডি অথবা হেফাজতের মামলার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুলি হল :-
- বৈধ পরিচয় পত্র, যেমন ধরুন:- প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, ভোটার আইডি কার্ড ইত্যাদি।
- বার্থ সার্টিফিকেট অথবা জন্মের প্রমাণপত্র
- বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত অথবা বিবাহের প্রমাণপত্র
- বাচ্চার পাসপোর্ট সাইজ এর ফটোগ্রাফ।
হিন্দু আইন কানুন অনুসারে চাইল্ড কাস্টডি:
একটি হিন্দু বাচ্চাকে হেফাজতে রাখার জন্য অভিভাবক ওয়ার্ড অধিনিয়ম 1890 আর হিন্দু সংরক্ষকতা অধিনিয়ম 1956 কে দেওয়া হয়েছে। যে আইন-কানুন জৈন, বৌদ্ধ এবং সি, এর মধ্যেও জারি করা হয়েছে। কেননা তারাও কিন্তু হিন্দু আইন কানুনের মধ্যে শামিল রয়েছেন।
হিন্দু সংরক্ষকতা অধিনিয়ম 1956 এর section-6 অনুসারে পাঁচ বছরের কম বয়সি হিন্দু বাচ্চার বাবা মা এর দেখাশোনার ক্ষেত্রে রাখা হবে। কেননা এই বয়সে কেবলমাত্র মা বাচ্চার উচিত সংরক্ষক হিসেবে মনে করা হয়। মানসিক, শারীরিক এবং নৈতিক ভাবে তাকে আগলে রাখার ক্ষেত্রে মা এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
১৮ বছরের কম বয়সের ছেলে অথবা অবিবাহিত মেয়ে আর পাঁচ বছর থেকে বেশি বয়সী বাচ্চা দের ক্ষেত্রে বাবার কাছে হেফাজত এর জন্য রাখা হবে। কেননা বাবা এই বয়সে প্রাকৃতিক সংরক্ষক হিসেবে পরিচিত বলে মনে করা হয়। আর তার মৃত্যুর পর তাদের দায়িত্ব মাকে দেওয়া হয়ে থাকে।
যদি বাচ্চা বে-আইনি হয়ে থাকে তাহলে তার হেফাজত কিন্তু মায়ের কাছেই হবে।
যদি বাবা-মা বাচ্চার হেফাজতের জন্য তৈরি না থাকেন, তাহলে বিচারালয় সেই বাচ্চার কল্যাণের জন্য তৃতীয় কোনো পার্টি কে রাখতে পারেন, সাধারণত হতে পারে দাদু দিদা।
যদি মাতা পিতা বাচ্চার কোন কাছের আত্মীয় এর দ্বারা বাচ্চার হেফাজত নেওয়ার কথা না বলে থাকেন, তাহলে বিচারালয় বিচার অনুসারে একজন উপযুক্ত ব্যক্তি কে বাচ্চার হেফাজতের জন্য নিযুক্ত করতে পারে।
মুসলিম আইন কানুন অনুসারে চাইল্ড কাস্টডি:
মুসলিম আইন কানুন অনুসারে এমন হেফাজতের অধিকারকে “হিজানাত” বলা হয়ে থাকে।
একজন মুসলিম বাচ্চার হেফাজতের জন্য মাকে নিযুক্ত করা হয়ে থাকে। যদি ছেলে হয়ে থাকে তাহলে তার হেফাজতের জন্য বয়স সাত বছর আর মেয়ে হয়ে থাকলে তার যৌবন কাল পর্যন্ত।
সাত বছর বয়স প্রাপ্ত করার পর একটি ছেলে বহুমত প্রাপ্ত করার পর মেয়ের হেফাজত বাবার কাছে হয়ে থাকে, কেননা মুসলিম আইন কানুন অনুসারে বাবাকে স্বাভাবিক সংরক্ষক হিসেবে মানা হয়ে থাকে।
খ্রিস্টান আইন-কানুন অনুসারে চাইল্ড কাস্টডি:
ভারতীয় বিবাহ বিচ্ছেদ অধিনিয়ম 1869 এর সেকশন 41 অনুসারে বিচারালয় খ্রিস্টান বাচ্চাদের হেফাজত, শিক্ষা এবং রক্ষণাবেক্ষণের সম্পর্কে নির্ণয় নেওয়ার অধিকার আছে। সেই বাচ্চার কল্যাণ এবং তার সমস্ত দিক থেকে ভালো হওয়ার ধ্যান-ধারণা রাখার মধ্যে দিয়ে বিচারালয় বিচার করে থাকে।
বিচারালয় বাবা-মা দু’জনকেই হেফাজতে নেওয়ার জন্য নিষেধ করে থাকতে পারে। যদি সেই বাচ্চা মানসিক রূপে বিকশিত হওয়ার জন্য উচিত অবসর দিতে অসমর্থ হয়ে থাকে তো।
বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ এর পর বাচ্চার সম্পত্তির অধিকার আছে কি?
একটি বাচ্চা নিজের বাবার পৈতৃক সম্পত্তিতে অংশীদার হিসেবে অধিকারী হতে পারে। বাবা এবং মা এর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ থেকে বাচ্চাকে তার অধিকার থেকে কখনোই বঞ্চিত করা যাবে না। তাছাড়া এই পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে যে, এগ্রিমেন্ট এর মধ্যে এই বিষয়ে উল্লেখ থাকাটা প্রথম থেকেই জরুরী।
অর্থাৎ বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও বাবার সম্পত্তির অংশীদার থাকবে সেই সন্তান। আর এইভাবে আইন অনুসারে একটি বাচ্চা তাদের বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের পর নিজের জীবন এবং ভবিষ্যত দুটি সুন্দর করতে পারে সকলের সহযোগিতায়।