প্রতিনিয়ত উৎসবের আনন্দ বাঙ্গালীদের জীবনকে করে তুলেছে আনন্দমুখর। বাঙালির “বারো মাসে তেরো পার্বণ” এই কথাটা প্রায় সকলের মুখে লেগেই রয়েছে। বলা যেতে পারে সারা বছর ধরে চলে উৎসব অনুষ্ঠানের পালা।
বিজয়া দশমীর মন খারাপ কাটিয়ে আবার নতুন আনন্দে গা ভাসিয়ে থাকেন সমগ্র বাঙালি। কেননা আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমায় সকলের ঘর আলো করে চলে আসেন মা লক্ষ্মী। আর তাকে স্বাগত জানাতে গৃহস্থ বাড়ির সদস্যরা কোন জায়গাতেই কমত রাখেন না।
সংসারে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, অর্থ লাভ সবকিছু সম্ভব হয় মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদে। কেননা তিনি যে ধন-সম্পত্তির দেবী। কিন্তু এই যে দেবী লক্ষ্মী বড়ই চঞ্চলা, তিনি বেশি ঘনঘটা, উচ্চস্বরে শব্দ এবং কোলাহল পছন্দ করেন না। যে ঘর তার পছন্দ হয় সে ঘরে তিনি চিরকালের জন্য থেকে যান।
তবে অনেকেই দেবী লক্ষ্মী কে সন্তুষ্ট করার জন্য পুজোতে কোনরকম কমতি রাখেন না। কিন্তু এর মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেন না যে, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার সময় বেশ কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। যেগুলো মেনে চলা শাস্ত্রমতে আপনার সংসারের জন্য খুবই মঙ্গলজনক।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা বিধি: অভাব অনটন দূর হবে এই নিয়ম মেনে পূজা করলে
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, মা লক্ষ্মীকে তুষ্ট করতে এবং আপনার সংসারে সর্বদাই তাকে ধরে রাখতে এমন কিছু নিয়মকানুন সম্পর্কে:
প্রতিটি দেব-দেবী এক এক রকমের পছন্দ রাখেন। যেমন ধরুন কোন দেবতা সাদা ফুলের সন্তুষ্ট, তো কোন দেবতা রঙিন ফুলে। আর এই দিকটা অনেকেই খেয়াল করেন না। এই সামান্য বিষয়ও যে দেব-দেবী আপনার উপরে অসন্তুষ্ট হতে পারেন, সে ধারণা হয়তো আপনার নাও হতে পারে। অথচ ভক্তি ভরে নিষ্ঠার সাথে পূজা করেছেন।
১) পূজার ফুল:
পূজা আর ফুলের সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িত। প্রথমত আমরা যেকোনো অনুষ্ঠানে, উৎসবে এবং পূজা পার্বণে ফুল ছাড়া ভাবতেই পারি না। তেমনি কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাতে ও ফুল অবশ্যই প্রয়োজন। এই পূজায় আপনি অর্পণ করবেন, সেই ফুল যেন কখনোই সাদা ফুল না হয়।
লক্ষ্মী পূজার সময় সাদা রং থেকে একটু বিরত থাকার চেষ্টা করুন। তাতেই কিন্তু আপনারই মঙ্গল, এর বদলে আপনি ব্যবহার করতে পারেন গোলাপী অথবা লাল রঙ। ফুলের ক্ষেত্রেও এই রঙের ব্যবহার আপনি করতে পারেন।
অর্থাৎ এক কথায় বলা যেতে পারে, লক্ষ্মী পূজায় সাদা ফুল বাদ দিয়ে অন্যান্য বিভিন্ন রঙিন ফুল আপনি দেবীকে অর্পণ করতে পারেন।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা: বাড়িতে পুরোহিত ছাড়াই পূজা করুন এই পদ্ধতিতে
২) উচ্চস্বরে শব্দ, কোলাহল:
লক্ষ্মী পূজায় কখনোই ঢাক-ঢোল, কাঁসর, ঘন্টা বাজাবেন না। কেননা দেবী কোলাহল পছন্দ করেন না। যে বাড়িতে সর্বদাই কোলাহল লেগেই রয়েছে, ঝগড়াঝাঁটি লেগেই রয়েছে, সেখানে কখনোই লক্ষ্মী থাকতে পারেন না।
আর তাই দেবী খুবই শান্ত পরিবেশ পছন্দ করেন। তাই এই লক্ষ্মীপূজাতে এমন কোন আচরণ আপনি যেন না করেন, সেই দিকটা খেয়াল রাখবেন।
৩) দান ধ্যান:
দান ধ্যান করা অনেকখানি পূণ্যের কাজ। সে ক্ষেত্রে আপনি যেকোন কাউকে দান ধ্যান করতেই পারেন। তবে এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাতে কখনোই কাউকে পূজায় ব্যবহৃত চাল দান করবেন না। এতে আপনার সংসারের উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা: মনের মত ফল পেতে এই কাজগুলি ভুলেও করবেন না
৪) তুলসী পাতা:
প্রতিটি পূজায় তুলসী পাতা লাগে, এমনটাই ধারণা করা হয়। কিন্তু এমন দেবদেবী রয়েছেন, যাদের পূজাতে তুলসী পাতার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। লক্ষ্মী পূজার ক্ষেত্রেও তাই এই পূজাতে দেবী লক্ষ্মী কে কখনই ভুলেও কিন্তু তুলসী পাতা নিবেদন করবেন না।
পুরান মতে শালগ্রাম শিলার সাথে তুলসীর বিয়ে হয়েছিল। শালগ্রাম শিলা বিষ্ণুর প্রতীক এবং বিষ্ণুর স্ত্রী হলেন শ্রী লক্ষ্মী, তাই এই পূজায় তুলসীর ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ। বাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার সময় এই বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা জরুরী।
৫) প্রদীপ ও ধুপের অবস্থান:
পূজা পার্বণে প্রদীপ এবং ধুপ বিশেষ ভাবে জড়িত, বলা যেতে পারে প্রদীপ ধুপ ছাড়া পূজা সম্পন্ন হয় না বললেই চলে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্মী পূজার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, পুজোর সময় দেবীর বাম দিকে যেন প্রদীপ ধুপ রাখা হয়।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা: আর্থিক সমস্যা দূর করতে এই কাজগুলি করুন
৬) পূজার পাত্র:
দেবীকে ভোগ নিবেদন করা থেকে শুরু করে আরো অন্যান্য ক্ষেত্রে পূজার পাত্র প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার সময় কাঁসার বাসনপত্র ব্যবহার করুন।
এখানে যেন কোনো রকম লোহার বাসনপত্র ব্যবহার না করা হয় বা অন্য কোন ক্ষেত্রে লোহার ব্যবহার যেন না হয়।
৭) ঘি এর প্রদীপ:
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, লক্ষ্মী পূজার দিন সারারাত ব্যাপী যদি আপনি ঘি এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন আপনার ঠাকুরঘরে, তাহলে দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ সর্বদাই থাকবে আপনার উপর।
এছাড়া কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন দেবী লক্ষ্মী সকলের ঘরের দোরগোড়ায় গিয়ে দেখেন যে, কার ঘর প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে সারারাত ধরে ঘি এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে ভুলবেন না কিন্তু।
৮) রাত্রি জাগরণ:
ভক্তিভরে পূজা করলে, মন থেকে ঈশ্বরকে ডাকলে তিনি ভক্তের ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেন। সেই কারণে দেবীর নৈবেদ্য অল্প হলেও যদি মনে থাকে অনেকখানি ভক্তি তাহলে আপনার ঘরে দেবী লক্ষ্মীর আগমন ঘটবেই। সারাদিনের পরিশ্রমের পর অনেকেই কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার শেষে ঘুমিয়ে পড়েন।
তবে দেবী কিন্তু মাঝরাতে সকলের ঘরে গিয়ে দেখেন তাকে স্বাগত জানাতে কোন বাড়ির গৃহিনী অথবা কোন বাড়ির মানুষজন জেগে রয়েছেন। তবে এই রীতি নিয়ে রয়েছে অনেক পৌরাণিক কাহিনীও।
“কোজাগরী” কথার অর্থ হল “কে জেগে আছো” আর সেই কারণে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন রাত্রি জাগরনের এই রীতিটি অনেকেই পালন করেন।
৯) চালের গুঁড়ার আলপনা:
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাতে চালের গুঁড়া দিয়ে আলপনা করা তার মাঝে মাঝে সিঁদুরের ফোটা, মায়ের পদচিহ্ন সবকিছু ঘর বাড়ি, ধানের গোলা, এমনকি শস্য ভান্ডার থেকে শুরু করে অর্থ সম্পদ যেখানে রাখা হয়েছে সেখানেও দেবীর পদচিহ্ন আঁকা হয়।
এই বিষয়টাও অনেকখানি শুভ হলে মনে করা হয়, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার সময় এই রীতিটি অনেকদিন আগে থেকে চলে আসছে।
১০) লক্ষ্মীর পাঁচালী:
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার সময় এমনকি অন্যান্য লক্ষ্মী পূজাতেও লক্ষ্মীর পাঁচালী প্রায় প্রতিটি গৃহিনীরাই পাঠ করে থাকেন। এক্ষেত্রে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজাতে আপনি লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ করতে পারেন। এ
তে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে আপনার সংসারে ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করবেন, তার অশেষ কৃপা থাকবে আপনার পরিবারের সকলের উপর।
দুর্গাপূজার শেষে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা বাঙালির জীবনে এক নতুন আনন্দের বন্যা বয়ে নিয়ে আসে। আকাশে সম্পূর্ণ চাঁদ, চারিদিকে দিনের মতো জ্যোৎস্না, বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ, সব কিছু মিলিয়ে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি বিশেষ উৎসব বলা যেতেই পারে।
ধন-সম্পদের দেবীকে সন্তুষ্ট করতে আয়োজন আর আড়ম্বরের শেষ নেই। প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে পড়ুক মা লক্ষ্মীর অশেষ কৃপা। সকলের জীবন ভরে উঠুক ধন সম্পদে। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার অনেকখানি শুভেচ্ছা রইল সকলের জন্য।