বুটা কোলা কি? কেন পালন করা হয়? আসল ইতিহাস ও ঘটনা জানুন

বুটা কোলা কি সত্য? বুটা কোলা কেন পালন করা হয়? বুটা কোলার ঐতিহ্য কি? বুটা কোলা কিভাবে শুরু হল? কারা বুটা কোলা করে? ভূত কোলা কি হিন্দু সংস্কৃতি? জানুন সবকিছু এখানে

সুন্দর এক জীবনের জন্য কোন না কোন দেব দেবীকে উপাসনা করে থাকেন সকলেই, তেত্রিশ কোটি দেব দেবীদের মধ্যে অনেক দেব-দেবীদের নাম হয়তো একেবারেই অজানা। তেমনি একটি উৎসব যা অনেকটাই ঐতিহ্য বহন করে আর তার সাথে সাথে মানব জীবনের অনেক মাহাত্ম্য ও লুকিয়ে রয়েছে।

সেই উৎসবের নাম হল বুটা কোলা। ভারতের একটি লৌকনাটক বলা যেতে পারে। অনেকেই আবার এই উপাসনা অথবা উৎসবকে ভূতা কোলা ও বলে থাকেন।

বুটা কোলা কি? কেন পালন করা হয়? আসল ইতিহাস ও ঘটনা জানুন
বুটা কোলা কি? কেন পালন করা হয়? আসল ইতিহাস ও ঘটনা জানুন

আমাদের চারিপাশে এমন অনেক অজানা উৎসব হয়েছে যেগুলি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ জানেন না বললেই চলে। অজানা কে জানার জন্য উৎসাহ প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই থাকে। আর সেই সম্পর্কে জানতে পারলে অনেক তথ্য সম্পর্কে জানাও যায়।

তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক বুটা কোলা সম্পর্কে এমন কিছু চমকপ্রদ তথ্য:

বুটা কোলা আসলে কি?

বুটা কোলা এমন একটি উৎসবের নাম যেখানে অনেক রকম অর্থ নিহিত রয়েছে। যেমন ধরুন তুলু ভাষায় বুটা শব্দের অর্থ আত্মা / দেবতা থেকে এসেছে।

এটি এসেছে আবার সংস্কৃত ভূত শব্দ থেকে যার অর্থ মুক্ত উপাদান যেটি শুদ্ধ যথাযথ অতীত সত্য উপযুক্ত জীব এমন শব্দ থেকে এবং কোলা শব্দের তুলু ভাষায় অর্থ হল অভিনয়, খেলা, উৎসব এগুলি বোঝাতে।

বুটা কোলা প্রতিবেশী মালায়ালাম ভাষী মানুষদের সাথেও জড়িত। এক কথায় বলা যেতে পারে অনেক গুলি আত্মার পূজা অর্চনা কে বুটা কোলা বলা হয়।

বুটা কোলা কেমন উৎসব? এর অন্তর্নিহিত অর্থ:

বুটা কোলা অথবা নেমা বিশেষভাবে একটি বার্ষিক আচার অনুষ্ঠান যেখানে স্থানীয় আত্মা বা উপাস্য দেবতাকে (ভূত বা দৈব) নির্দিষ্ট তফসিলি বর্ণের ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ দ্বারা নির্দিষ্ট পথে প্রেরণ করা হয়।

এই বিশেষজ্ঞরা হল নালিকে পাম্বাদা অথবা পারাওয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন। বুটা হল একরকম ধর্মানুষ্ঠান। তুলু নাড়ু অঞ্চলের তুলু জাতির অ-ব্রাহ্মণ দের মধ্যে এই উপাসনা প্রচলিত।

বুটা কোলা উৎসব
বুটা কোলা উৎসব

কোলা শব্দটির প্রচলিত হবে একক আত্মার উপাসনার জন্য সংরক্ষিত এবং নেমা শব্দটি উপর থেকে নিচে শ্রেণীবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন আত্মার নির্দিষ্ট পথের সাথে জড়িত। কোলা ও নেমা পরিবার এবং গ্রাম্য বিবাদে মধ্যস্থতা ও বিচারের জন্য আত্মার কাছে অর্পণ করা হয়। এই প্রথা সামন্তকালীন যুগে বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল।

এছাড়াও আচারের ন্যায় বিচারের দিকটিতে রাজনৈতিক ন্যায় বিচারের বিষয়গুলি যেমন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বৈধতা এবং এর পাশাপাশি ন্যায় বিচার বিতরণের দিক গুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এছাড়া বলা যেতে পারে বুটার মালিকাধীন জমির উৎপাদন অর্থাৎ সাধারণ মানুষজন এবং নেত্রী স্থানীয় জমিদারদের কিছু উৎপাদন গ্রাম বস্তির মধ্যে পুনরায় বিতরণ করা হতো।

বুটা কোলা কোথায় পালন করা হয়?

বুটা কোলা অথবা ভূতা এটি হলো ভারতের কর্নাটক রাজ্যের তুলু নারুর উপকূলীয় জেলাগুলির ও মলেনাটোর কিছু অংশের এবং উত্তর কেরল রাজ্যের কাসারগড় অঞ্চলের আধ্যাত্মিক উপাসনার একটি প্রাণিজ রূপ।

এই  উপাসনাতে একটি নাচ খুবই জনপ্রিয় এই নাচটি অত্যন্ত শৈলী যুক্ত এবং তুলুবাসি জনগোষ্ঠীর উপাসনা করা স্থানীয় দেব-দেবীদের সম্মানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এছাড়াও এই উপাসনা যক্ষগণ লৌহ নাটক কে প্রভাবিত করে।

বুটা কোলার প্রদর্শনী:

বুটা কোলা এই উপাসনার সাথে প্রদর্শনী হিসেবে অনেক কিছুই যুক্ত রয়েছে। তেমনি এই দেবতা ও আত্মাদের উপাসনাতে অনুষ্ঠান প্রদর্শন এর ক্ষেত্রে সংগীত, নৃত্য, গায়ন আর বিস্তৃত বেশভূষা ও শামিল রয়েছে। পুরানো তুলু তে গায়ন দেবতা এর উৎপত্তি বর্ণনা করেও অনেক কাহিনী রয়েছে।

দেব বা দৈব কি? এবং কয় প্রকার?

৩৩ কোটি দেবদেবীদের মধ্যে কয়েকটা হাতে গোনা দেবদেবীদের নাম আমাদের জানা, দেব বা দৈব সম্পর্কে আমরা কম বেশি সকলেই জানি কেননা দেবতা এবং অপদেবতা সম্পর্কে বলতে গেলে ঈশ্বরকে দেবতা অথবা দৈব শক্তির আধার বলে আমরা মনে করি। এমনি এক শক্তি যার উপাসনা করে সাধারণ মানুষ নিজেদের মনের কথা জানিয়ে সমস্ত রকম বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রার্থনা করে থাকেন।

এক একটি জায়গায় এক একটি দেব দেবীদের প্রাধান্য দিয়ে সেখানে তাদের উপাসনা করে পূজা অর্চনা ও আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে স্থানীয় মানুষজন নিজেদের কষ্টের কথা জানিয়ে খুবই জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সেই দেবদেবীদের উপাসনা করে থাকেন।

দেব / দৈব এর প্রকাভেদ: 

সব থেকে প্রসিদ্ধ দেবতাদের মধ্যে এই সমস্ত দেব দেবী ও পড়েন যারা হলেন: জুমাদি, সরলা জুমাদি, পঞ্চজুমাদি, পঞ্চরোলি, রক্তপঞ্ছরলি, তুক্কটেরি, কোরোগজ্জা, চামুন্ডি, কোল্লুরতি, কোরাথি, সিরি, মন্ত্রদেবতে, রক্তদেবতে ইত্যাদি।

আবার এটাও মনে করা হয় যে, ভূত বিভিন্ন জাতির সমন্ধিত, উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে অক্ষুবল্লালা এবং দীপাঞ্জিরি জৈন ও আছে, কোডমনিতায়া এবং কুক্কিনাটোয়া বন্ট ও আছে। এদের মধ্যে কিছু অপদেবতা অর্থাৎ আত্মা ও রয়েছেন যারা পূজিতা হয়ে থাকেন স্থানীয় মানুষজনদের কাছে অর্থাৎ বলা যেতে পারে তারা এই সমস্ত আত্মাদের উপাসনা করেন।

যেমন ধরুন: বোব্বরিয়া, কলকুন্ট, কল্লুরতি, কুমারকোটি, সিরি, এবং চৈন্নইয়া। কিছু দেবতা রয়েছে যারা জংলি হিংস্র জীবজন্তু যেমন ধরুন শুয়োর, পঞ্চুরোলি (মহিলা সমকক্ষ পঞ্জুরোলি অথবা বাঘ) পিলিচন্ডী।

এমন অনেক দেবতা রয়েছেন যারা জীবজন্তু, মাছ এই সমস্ত রূপ ধারণ করেছিলেন সেই হিসেবে সেই রূপেই তারা মর্তবাসীর কাছে পূজা পেয়ে আসেন। সেই অনুসারে এমন অনেক দেবতা বন্য জীবজন্তু রূপে বিভিন্ন জায়গায় উপাসনা পেয়ে থাকেন।

ভূত কোলা / বুটা কোলা এর প্রকার ভেদ:

দক্ষিণ কেনরা এর ভূত পূজা অর্থাৎ এই আত্মাদের উপাসনা চার রকমের হয়ে থাকে, যেমন কোলা, বন্ডি, নেমা আর অগেলু- তম্বিলা।

১) কোলা: ডেমি গার্ড নৃত্য, এই ধরনের নৃত্য গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ভূতদের অর্পন করা হয়, এটা মনে করা হয় যে, এর মধ্যে দিয়ে তারা স্থানীয় মানুষজনদের অনেকখানি মঙ্গল সাধন করে থাকবেন।

২) বন্ডি: বন্ডি হলো কোলা এর সমান সমান, এখানে একটি অস্বাভাবিক রকমের গাড়ির সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলা হয়। যার উপরে ভূতেদের প্রতিনিধিত্ব চলে যা কিনা নলকে, পাম্বড়া, অজলা সমুদয় এর মধ্যে পড়ে।

৩) নেমা: এটি এমন একটি আয়োজন যা কিনা ভূতেদের সম্মান জানানোর জন্য করা হয়। যেটা যেকোনো ইচ্ছুক ব্যক্তির ঘরে আয়োজন করা যেতে পারে। প্রতিবছরে, ২ বছরে, ১০ বছরে, ১৫ বছরে অথবা ২০ বছরে একবার সম্পন্ন পরিবার দ্বারা করা হয়ে থাকে।

৪) অগেলু-তম্বিলা: এই আয়োজন কেবলমাত্র পরিবারের মানুষজনদের দ্বারা সম্পন্ন করা হয়, এটি এক প্রকারের পূজা ও বলা যেতে পারে। যেখানে চাল, ব্যঞ্জন, মাংস, সুরা অথবা নেশা জাতীয় পানীয়, কলাপাতার উপরে সাজানো হয় আর আত্মাদের, দেবতাদের, মৃত পূর্বপুরুষ দের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর সম্পূর্ণ হওয়ার উপরে উৎসর্গ করা হয়।

ব্রহ্মাণ্ড বিজ্ঞান:

এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড খুবই রহস্যময় আর তার মধ্যেই আমাদের বসবাস এই সম্পর্কে আমরা কত শতাংশই বা জানি। আমাদের অজানা রয়ে গেছে অনেক কিছুই। এমনকি দেব-দেবী আত্মাদের বিষয়ও আমাদের সঠিক এবং সমস্ত ধারণা নেই বললেই চলে।

পৃথিবী দুই তিন ক্ষেত্রে বিভাজিত, প্রথমত ক্ষেত এর ভূমি অথবা গ্রাম অঞ্চল এর মাঠ, ঘাট দ্বিতীয়ত পড়ে থাকা জমি যেখানে কোনরকম চাষাবাদ হয় না আর জঙ্গল, অরণ্য যেখানে বিভিন্ন রকমের বন্য জীবজন্তুর বসবাস, তৃতীয়ত আত্মা দের ক্ষেত্র যেখানে ইহকাল ত্যাগ করে যাওয়ার পর স্থান হয় এই ক্ষেত্র তে। গ্রাম এবং জঙ্গল অরণ্য যে দুনিয়ার অংশ যেখানে ভূত লোক তাদের অমুর্ত্য সমকক্ষ।

এইভাবে জঙ্গল আর অরণ্য রূপে অতিক্রমণ, রোগ, খিদে আর মৃত্যু থেকে গ্রাম এর উপরে বিশেষভাবে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে থাকে, তেমনভাবে আত্মাদের অংশটিও কিন্তু মানুষ জঙ্গল আর গ্রাম এদের দ্বারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জঙ্গলের স্থানটি জংলি, অনিয়ন্ত্রিত, বিনাশ এই সমস্ত হিংস্র ক্ষুধার্ত প্রাণীদের জায়গা।

সেখানে গেলে যেমন গ্রামের মানুষদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি সেই হিংস্র প্রাণীরা ও যখন গ্রামের মধ্যে আসে তখনও কিন্তু তাদেরও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে যার জায়গায় সে সুরক্ষিত।

বুটা কোলার তাৎপর্য:

এইজন্য জঙ্গলের পরিবেশ অর্থাৎ সেখানকার পৃথিবীর আর আত্মাদের জায়গাটি একে অপরের আয়না হিসেবে দেখা যেতে পারে। জংলি অথবা বন্য জীবজন্তু মানব জগতে কৃষক আর সেই কৃষকের জমি ধ্বংস করে থাকে বাঘ, সাপ, বন্য শুকর আর বাইসন। এরাও কিন্তু গ্রাম্য মানুষদের ক্ষতি সাধন করে থাকে।

সেই জন্যই এই সমস্ত বন্য জীবজন্তুর রূপকে উপাসনা করে তাদের হুমকির হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়। নাগা পঞ্চরলি আর মইসনদয়া এগুলো কিন্তু বন্য জীবজন্তুর এক একটি রূপের চিত্ররূপ যা উপাসনার ক্ষেত্রে দেখা যায়।

বুটা কোলার তাৎপর্য
বুটা কোলার তাৎপর্য | image credits: @rakeshkonajephotography

এই তিনটি লোক অর্থাৎ এই তিনটি জায়গায় এর মধ্যে সম্বন্ধ অর্থাৎ যোগাযোগ সমান রাখার প্রতিষ্ঠা করা হয়। যদি এই আদেশ মানুষদের দ্বারা বিরক্ত করা হয়ে থাকে, তো এমন ক্ষেত্রে মনে করা হয় যে আত্মাদের বিক্ষিপ্ত করা হয়ে থাকে অথবা তাদেরকে রাগান্বিত করা হয়ে থাকে।

যদি এই আদেশ সুন্দর ভাবে সামঞ্জস্য করে রাখা হয়, তাহলে আত্মা দের সহায়ক আর পরোপকারী মনে করা হয়। তারা কখনোই কারো কোন ক্ষতি করে না।

এইভাবে তুলু সংস্কৃতিতে আত্মারা খুবই ভালো হয়ে থাকে। তারা কখনোই খারাপ হয় না, তারা কখনোই নিষ্ঠুর হয় না আর আবার অপরদিকে কখনোই একেবারে শান্তও হয় না। তাই তাদেরকে ভালোভাবে রাখার জন্য বিশেষ সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হয়। সেই কারণেই এই উপাসনার প্রয়োজন পড়ে।

কাউকেই এই তিন জায়গার অর্থাৎ এই ব্রহ্মাণ্ডের উপরে মনে করা হয় না। এমনও পর্যন্ত হয় যে আত্মাদের অথবা দেবতাদেরও নয়। অনেক আগে প্রাচীনকালে ভূ-অভিজাত  রাজারাও সুরক্ষিত থাকতো এবং তারাও কিন্তু অর্থাৎ আত্মারাও কিন্তু রাজাদের বিভিন্ন কাজে খুবই উপকার করত। সেখান থেকেই তাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে এই উৎসব ও উপাসনার আয়োজন করা হয় খুবই ধুমধাম ভাবে।

জঙ্গলের মধ্যে আর বাইরের পরিবেশে থাকা আদিবাসী সমূদয় আর অরণ্য থেকে উৎপাদন হওয়া কিছু জিনিসপত্রের ব্যবসা করার জন্য আত্মা প্রতিরোপ হিসেবে সেবা প্রদান করার জন্য পূর্বনির্ধারিত করা হয়েছে। কেননা তাদের জীবনের জায়গা অথবা তাদের পৃথিবী বলা যেতে পারে, তারা তাদের জায়গায় থেকে মানুষ জাতিদের অনেক উপকার করে থাকেন।

আত্মাদের উদ্দেশ্য উপাসনা করার জন্য উৎসবের আয়োজন করা হয়। তারা গ্রামের সীমান্তে জঙ্গল আর খেত জমিতে যেখানে কোনরকম চাষাবাদ হয় না বলতে গেলে একেবারে বন্ধ্যা জমিতে তাদের বসবাস। এইভাবে সীমান্তের মানুষদের আত্মাদের জন্য একটা মাধ্যম হওয়া খুবই জরুরী, আর এটা অর্থাৎ এই উপাসনার উৎসব উপযুক্ত বলে মনে করা হয়।

এছাড়াও গ্রামের চাহিদা অনুসারে গ্রামের দেবতা দের সম্মানিত করার জন্য বার্ষিক কোলা অথবা নেমা এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেখানকার স্থানীয় মানুষজন দের কথা অনুসারে আত্মাদের ছাড়া তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে।

যদিও অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও তবুও বুটা কোলা আর দৈব নাম এখনো পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ আর ধার্মিক উদ্দেশ্য কে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। বাস্তবে এই দুটি বিষয়কে এই বিশ্ব থেকে আলাদা করা যেতে পারে না, যেখানে একে অপরের পরিপূরক।

বুটা কোলার পূজা অর্চনা:

তবে এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে হিন্দু দেব দেবীদের মত দৈনিক আধারের উপর নির্ভর করে ভূতা অথবা দৈব এর পূজা করা যেতে পারে না। এদের পূজা বার্ষিক অনুষ্ঠান উৎসব এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া অনুষ্ঠানের জিনিসপত্র আভূষন আর বুটা কোলার অন্যান্য বিষয়ের জন্য দৈনিক পূজা করা যেতে পারে।

বুটা কোলার অনুষ্ঠান সূচি:

এই উৎসবের অনুষ্ঠান হিসেবে যেগুলি স্থানীয় মানুষজনদের দ্বারা সম্পন্ন করা হয় সেগুলি অনেকটাই চমকপ্রদক। অনুষ্ঠানের শুরুতে বুটা কোলা এর সমস্ত জিনিসপত্র মন্দিরে নিয়ে আসার সাথে সাথে উৎসবের জন্য একটি জায়গায় জড়ো করা হয়।

সেগুলি একটি বেদীর উপরে অথবা একটি ঝুলন্ত খাটের উপরে রাখা হয়, যা কিনা একটি রাজন দৈব এর প্রতীক। এরপর মালিক পরবা অথবা পাম্বারা এর মাধ্যমে আত্মা কে প্রতিরূপ এর জন্য ভুত অথবা দৈব এর সাথে উপাসনার জন্য তৈরি করা হয়।

এরপর উৎসবের আয়োজন এর জন্য সমস্ত রকম মেকআপ, ড্রেসিং এগুলি শুরু হয়ে যায়। শেষে যে মাধ্যমের মাধ্যমে এই উপাসনা চলতে থাকে সেই মাধ্যমকে মন্দিরের ভান্ডার থেকে আভূষণ দেওয়া হয়।

বুটা কোলা নাচ:

এক একটি উৎসবের সাথে এক একটি অনুষ্ঠান, নৃত্য, সংগীত, এগুলি জড়িত থাকে। তেমনি এই উপাসনাতে সুন্দরভাবে মেকআপ এর মধ্যে দিয়ে নাচের মঞ্চে অথবা কোন সমতল ভূমিতে তরবারি, ঘন্টা এবং আরো অন্যান্য সামগ্রী গুলির মাধ্যমে যে ব্যক্তি অথবা মহিলা নৃত্য করবেন তাকে দিয়ে থাকেন। এর সাথে সাথে জ্বলন্ত মশাল ও দেন যিনি এই নৃত্যের দায়িত্বে রয়েছেন।

বুটা কোলা নাচ
বুটা কোলা নাচ | image credit to prajavani.net

তারপর যখনই মাধ্যম অর্থাৎ যিনি নৃত্য করবেন তিনি নৃত্য করতে শুরু করবেন তখনই কিন্তু এই সমস্ত আত্মা তার শরীরে প্রবেশ করবে। মাধ্যমের সাথে সাথে দুজন ব্যক্তি সর্বদাই হাতে মশাল ধরে রাখেন এই নির্দেশনায়।

এইভাবে এই ক্ষেত্রে আত্মার প্রবেশ প্রতিবন্ধিত হয়। যত বেশি পরিমাণে আত্মার প্রভাব পড়তে থাকে ততই কিন্তু নৃত্যের বল অধিক হতে শুরু করে। এরপরে জ্বলন্ত সেই মশাল খুবই বিপদজনক ভাবে নিজেদের শরীরের কাছাকাছি নিয়ে আসতে শুরু করেন তারা।

বুটা কোলার আত্মাদের প্রসাদ:

একটি জায়গায় ভূত অথবা আত্মাদের প্রসাদ উৎসর্গ করা হয়। সেই প্রসাদের মধ্যে থাকে সাধারণত মুরগি সেখানে মুরগিদের বলি দেওয়া হয় যার রক্ত মাটিতে পড়ে, সেই মাটিকে উর্বর করে তুলতে পারে এমনটা মনে করে, চারিদিকে সেই রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এরপরেই মুড়ি, নারকেলের টুকরো, কলা, ঘি, সুপারি, এই সমস্ত প্রসাদ গুলি উৎসর্গ করা হয়।

এরপরে তাদের আশীর্বাদের জন্য আত্মার সাথে যোগাযোগ করা হয়ে থাকে এবং বিভিন্ন রকমের সংঘর্ষ সমাধান করার জন্য সাহায্য করার ক্ষেত্রে তাদেরকে বলা হয়ে থাকে। এই নৃত্য অনুষ্ঠান প্রাথমিক অনুষ্ঠান গুলি সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পরেই শুরু হয়। অভিযোগ এবং নির্ণয় মৌখিক হিসেবে করা হয়।

ভুতা বাদী এবং প্রতিবাদী এই দুই পক্ষের থেকে শোনার পর তবেই নির্ণয় করা হয়। যদি দুজনে উপস্থিত থাকে তো। ভুতা অথবা বুটা এর ন্যায় সাধারণ সিদ্ধান্তের মধ্যে হতে হবে।

আর সে কখনোই কোন পক্ষ নিতে পারে না, যখন কোন গ্রাম প্রধান আর অন্য কোন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের রায় কে খেয়াল রাখতে পারেন, শেষ নির্ণয় বুটা অথবা ভুতার সাথে হয়। কখনো কখনো পানের পাতা উড়িয়ে এবং ফুলের পাপড়ি এগুলি গণনা করার মাধ্যমেও সিদ্ধান্ত শোনানো হয়ে থাকে।

বিশেষভাবে কঠিন কোন মামলা ও বুটা বা ভুঁতা দ্বারা আগামী বছরের জন্য স্থগিত করা যেতে পারে। ভূমি বিবাদ, মান সম্মান এর প্রশ্ন, পারিবারিক কলহ, ডাকাতি, ঋণ, বন্ধক রাখা, আইন অমান্য, এই সমস্ত কিছু সাধারণ বিবাদ সামনে আসে।

বুটা কোলার উপাসনা
বুটা কোলার উপাসনা

চুরি করার বিষয়ে যেখানে অপরাধী একেবারেই অজানা সেক্ষেত্রে কিন্তু ভূতা চোর খোঁজার জন্য প্রথমে নিশ্চিত ভাবে কোনো উপহার চাইতে পারেন। কখনো কখনো চুরি হয়ে যাওয়া সেই জিনিসপত্রের সম্পূর্ণ দামও ভূতা দিয়ে দেয়। যদি চোর ধরা যেতে পারে আর তাকে শাস্তি দেওয়া হয়।

তাহলে সেই চোর ব্যক্তিকে একটা এমাউন্ট ভরপাই করার জন্য বলা হয়। যা কিনা চুরি যাওয়া জিনিসপত্রের দামের তুলনায় অনেক বেশি। আবার যদি ভূতা মনে করেন যে চুরি করার পিছনে কোন কারণ দেখাচ্ছে সেই চোরের তাহলে শাস্তির পরিমাণ অনেক কম হতে পারে।

বুটা কোলার উপাসনার কমিটি:

মাধ্যম অর্থাৎ যিনি এই উপাসনাতে নৃত্য প্রদর্শন করে থাকেন অথবা এই উপাসনার সাথে বিশেষভাবে জড়িত, তিনি বিভিন্ন ধরনের কলা শিখে রাখেন।

মালিক জাতিদের যুবক ছেলেরা এই অনুষ্ঠানে শামিল হন। যেখানে তাদের প্রিয়জন প্রদর্শন করে থাকেন এবং তারা মাধ্যমের পরিধান করার জন্য নারকেল গাছের পাতা কাটার ক্ষেত্রে অনেকটাই সহযোগিতা করে থাকেন।

যখন এই নৃত্য শিল্পের মেকআপ সাজ পোশাক এই সমস্ত চলতে থাকে, তাছাড়া পরিজনদের প্রদর্শন দেখতে দেখতে তাদের নকল করতে করতে এই সমস্ত প্রদর্শন গুলি শেখার চেষ্টা তে অনেকটাই শিখে ফেলেন।

নিজের আত্মীয়-স্বজনদের প্রদর্শন নকল করার ক্ষেত্রে সক্ষম হওয়ার সাথে সাথে একটি সফল চ্যানেল অথবা মাধ্যম হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন সেই সবগুলি দেবতাদের কাছে হওয়াটাও জরুরী। এছাড়া আমরা আগেই জেনেছি যে নৃত্য করার সময় আত্মাদের ভর অথবা তাদের শক্তি এদের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে।

সেই কারণে তাদের শরীরকে দখল করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। তার জন্য বেশ কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। এর মধ্যে যেমন বিশেষভাবে মাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে নিরামিষ ভোজী হতে হবে এবং কোনরকম নেশা জাতীয় পানিও বা দ্রব্য সেবন করা যাবে না।

চ্যানেল অথবা মাধ্যম কিছু সেকেন্ডের জন্য হঠাৎ করে আত্মার দখলে অথবা তাদের কবজাতে রয়েছেন, এমনটা অনুভব করতে পারবেন। কিন্তু তারপরে সেই মাধ্যম দেবতার উরজা (শক্তি) তে সম্পূর্ণ ভরে যায়। যেটা তাকে সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের জন্য তাকে দেবতার রূপে ব্যবহার করার জন্য একটা সুযোগ দিয়ে থাকে।

বুটা কোলার মাধ্যম:

আত্মা আর মানুষের মধ্যে দুই রকমের মাধ্যম হয়ে থাকে প্রথম মাধ্যম হলো পিতৃ রূপ, এই মাধ্যম জাতির সদস্য যেমন ধরুন বিলবা। দ্বিতীয়তঃ হলো মাধ্যম সাধারণত যখন পিতৃ এর কাছে কেবলমাত্র একটি তরবারি ও একটি ঘন্টা থাকে যা কিনা অনুষ্ঠানের উপকরণ রূপ হিসেবে মনে করা হয়।

চ্যানেলের মাধ্যম সাজ পোশাক আভূষণ এবং বিভিন্ন ধরনের মুকুট ব্যবহার করে থাকেন। মনে করা হয় যে দুটি মাধ্যম চেতনার পরিবর্তন এর অবস্থাতে দেবতাকে দিশা প্রদান করে।

কিন্তু যখন চ্যানেল অথবা মাধ্যম ভূতা আর বুটার সম্পর্কে বলতে পারে, সে ক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তিদের অর্থাৎ যখন সে নিজের বিষয়ে বলতে শুরু করেন তো প্রথম ব্যাক্তি কেবলমাত্র পদ্দান্না রূপেই বলতে পারবেন।

পাঞ্জুরোলি দৈব: 

এক কথায় বলা যেতে পারে পাঞ্জুরোলি বরাহ / শুকর আত্মা দেবতা। আমরা আগেই জেনেছি জঙ্গলের হিংস্র জীবজন্তু তারাও কিন্তু উপাসনার ক্ষেত্রে অংশ নিয়ে আছে।

পাঞ্জুরলি দৈবের মুখোশ (শূকর আত্মা দেবতা)
পাঞ্জুরলি দৈবের মুখোশ (শূকর আত্মা দেবতা)

আর তাই বুটা কোলা এই উৎসবে শুকর অর্থাৎ বন্য শুকর এর মুখোশ পরে নৃত্য পরিবেশন করাটাও এই উৎসবের একটি বিশেষ অংশ, আর ঐতিহ্যবাহীও বটে। নৃত্যের মধ্যে বিভিন্ন আত্মার প্রবেশ ঘটে মানব শরীরে। তার মধ্যে দিয়েই সকলের ভালো করার প্রয়াস চলে।

পদ্দান্না আসলে কি? 

পদ্মন্না তুলু বা মৌখিক এর সাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। এই সাহিত্যের অধিকাংশ ভাগ ভুত আর দৈব এর বিভিন্ন ধরনের কাহিনীতে ভরপুর। অন্যান্য মহাকাব্য এবং পরম্পরা অনুসারে একজনও লেখক নেই। পদ্দান্না মৌখিক হিসেবে প্রসারিত আর পড়া হয়ে থাকে, অর্থাৎ মুখে মুখে প্রচারিত। পদ্দান্না এর ভাষা হল পুরানো তুলু ভাষা।

কিছু প্রসিদ্ধ উদাহরণ যেমন শ্রীকুমার পদ্দান্না আর কোটি এবং চৈন্নইয়া পদ্মনা। যখন ধান রোপন করা হয় সেই সময় মহিলাদের দ্বারা যে গান গাওয়া হয়, সেই সংগীত পদ্দান্না কে ক্ষেত গীত বলা হয়ে থাকে।

পদ্দান্না পৌরাণিক পুরুষ আধারিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ও দাড়িয়ে থাকে। কেননা সে ধরণী মাতার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে থাকে। পদ্দান্না হিন্দু করণ ও সংস্কৃতি করনের প্রক্রিয়াকেও দেখিয়ে থাকে।

দেবতাদের পাশাপাশি ভূত, আত্মা, বন্য হিংস্র জীব জন্তু তাদের কেও উপাসনার মধ্যে দিয়ে শান্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতে হয়। এর ফলে যেন কোন মানুষের ক্ষতি না হয়ে থাকে তাদের দ্বারা এবং মানুষের দ্বারাও তাদের যেন সাজানো বিশ্বতে কোনরকম ব্যাঘাত না ঘটে।

এভাবে সকলের মঙ্গল কামনায় এমন উৎসবের আয়োজন করা হয় কর্ণাটক এর মলে নাড়ু এর কিছু অংশে এবং উত্তরের কেরল ভারতের কাসরগড় এই সমস্ত জায়গা থেকে আত্মা পূজা একনিষ্ঠ এক উপাসনা বলাই যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top