আমাদের সকলের জীবন কতটা না রহস্যময়, কেননা আমরা একটুখানি সুখ শান্তির জন্য কত কিছুই না করে থাকি। পূজা-অর্চনা থেকে শুরু করে এমন অনেক ছোটখাটো নিয়ম রয়েছে যেগুলি মেনে চলতে আমরা দ্বিধাবোধ করি না। তেমনি বাড়িতে তুলসী গাছ নিয়েও এমন অনেক সামান্য জিনিস রয়েছে, যেগুলি মেনে চললে আপনার জীবন সম্পূর্ণ রূপে পরিবর্তিত হতে পারে।
প্রতিটি হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বাড়িতে তুলসী গাছ থাকবেই, তবে তুলসী গাছ নিয়ে এমন অনেক জানা-অজানা রহস্য রয়েছে, যেগুলি সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন না। এমন অনেক নিয়ম রয়েছে যেগুলি মেনে চললে আপনি লাভবান হবেনই।
হিন্দু ধর্মে তুলসী গাছের গুরুত্ব অনেকখানি, এই গাছটি দেবতার মত, কারণ তুলসীকে দেবী লক্ষ্মী অথবা সম্পদের দেবীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে আপনার জীবনে যদি কোন আর্থিক সমস্যা থাকে তবে দেবী লক্ষ্মীর রূপে এই যে তুলসী গাছ কে যদি আপনি পূজা করে থাকেন, তাহলে আপনি অনেক খানি উপকৃত হবেন।
তুলসী গাছ সম্পর্কে এমন অনেক অজানা নিয়ম রয়েছে, যেগুলি পালন করলে আপনি শুভ ফল লাভ করতে পারবেন। শুধুমাত্র তুলসী গাছ বাড়িতে লাগিয়ে সেটা ওই ভাবেই ছেড়ে দিলেই কিন্তু সংসারে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি আসবে না, তার জন্য আপনাকে একটু তো কষ্ট করতেই হবে, তাই নয় কি !
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, তুলসী গাছ সম্পর্কিত এমন কয়েকটি অজানা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম সম্পর্কে:
১) কার্তিক মাসে বাড়িতে আনুন তুলসী গাছ:
অনেকেই হয়তো ভাবছেন বাড়িতে তুলসী গাছ লাগানোর কথা, আবার দেখা যায় নতুন বাড়ি করেছেন সে ক্ষেত্রে বাড়িতে তুলসী গাছ লাগাতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে আপনি কার্তিক মাস কে বেছে নিতে পারেন। কেননা কার্তিক মাসে বাড়ি তে তুলসী গাছ লাগানোর সেরা সময়।
তুলসীকে লক্ষ্মীর রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বলা হয় যে কার্তিক মাসে একটি তুলসী গাছ বাড়িতে আনলে দেরী লক্ষ্মীও সেই সাথে সাথে গৃহস্থ বাড়িতে প্রবেশ করেন। তাই আপনি দুই ভাবেই উপকৃত হবেন। তুলসী গাছের সাথে সাথে ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মী কেও নিজের বাড়িতে অধিষ্ঠিত করতে পারবেন।
২) কার্তিক মাসের বৃহস্পতিবার:
শাস্ত্র অনুসারে কার্তিক মাসের যে কোন বৃহস্পতিবার বাড়িতে তুলসী গাছ আনতে পারেন। বৃহস্পতিবার হল ভগবান বিষ্ণুর দিন এবং শ্রী বিষ্ণুর রূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে তুলসী হল খুবই প্রিয়।
আর কার্তিক মাসের বৃহস্পতিবার এ তুলসী গাছ বাড়িতে আনলে তা আপনার সংসারের জন্য মঙ্গলজনক।
৩) দক্ষিণ দিক নৈব নৈব চ:
তুলসী গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে ভুল করেও বাড়ির দক্ষিণ দিকে তুলসী গাছ রাখা উচিত নয়। এই দিকটি পূর্বপুরুষের এবং এখানে তুলসী গাছ রাখলে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। তাই এদিকটা বিশেষভাবে খেয়াল রাখা জরুরী।
৪) উত্তর-পূর্ব কোন:
বাড়িতে তুলসী গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে তুলসী গাছ সবসময় বাড়ির উত্তর অথবা উত্তর পূর্ব দিকে লাগাতে হয়, পুরাণের কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এই দিকে দেবতাদের অধিবাস।
৫) সব জায়গায় নয়:
বাড়ির এমন কোন জায়গা হয়তো রয়েছে সেখানে আবর্জনা, জুতো, চপ্পল খুলে রাখা হয়। সেই সমস্ত জায়গায় কখনোই তুলসী গাছ রাখা যাবে না।
বাড়ির প্রবেশদ্বার এবং আঙ্গিনার যেকোনো জায়গায় যদি আবর্জনা থেকে থাকে সেক্ষেত্রে সেই জায়গা তুলসী রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ত হলেও সেখানে তুলসী গাছ রাখা যাবে না।
৬) মাটির পাত্র:
অনেক সময় দেখা যায় অনেকের টবে তুলসী গাছ লাগাতে চান, সেক্ষেত্রে মাটির পাত্রে সর্বদাই একটি তুলসী গাছ লাগাতে পারেন। প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা যাবে না।
তুলসীর টব টি গেরুয়া রং করুন এবং সম্ভব হলে তাতে চুন অথবা হলুদ দিয়ে “শ্রী কৃষ্ণ” লিখতে পারেন।
৭) সব সময় তুলসী গাছ স্পর্শ করা নিষেধ:
নিয়মিত তুলসী পূজা করা যেতেই পারে, তবে সন্ধ্যায় তুলসী গাছ স্পর্শ করা নিষেধ রয়েছে। এছাড়া একাদশী, রবিবার, চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের দিনেও কিন্তু তুলসী গাছ স্পর্শ করা উচিত নয়।
এ ছাড়া সংক্রান্তিতে তুলসী পাতা কোনভাবেই তোলা যাবে না। এছাড়া রবিবারে তুলসী গাছে জল নিবেদন করাও নিষেধ রয়েছে।
৮) কাঁচা দুধ নিবেদন:
আমরা সব সময় তুলসী গাছে জল নিবেদন করতেই দেখেছি, তবে তুলসীতে জল নিবেদন করার পাশাপাশি কাঁচা দুধও দেওয়া যেতে পারে।
এটা বিশ্বাস করা হয় যে, কাঁচা দুধ তুলসী গাছে নিবেদন করলে তা সংসারের সকল দুর্ভাগ্য দূর করে দেয়।
৯) তুলসী প্রদক্ষিণ:
আপনি যদি প্রতিদিন তুলসী গাছকে প্রদক্ষিণ করতে চান তাহলে জল নিবেদন করার সময় তুলসী গাছ কে তিনবার প্রদক্ষিণ করতে পারেন, প্রথমে সূর্যকে জল নিবেদন করতে হবে, তারপরে তুলসী গাছে জল নিবেদন করতে হবে।
১০) প্রসাদ হিসেবে তুলসী পাতা:
কিছু পূজা ছাড়া প্রায় প্রতিটি পূজায় তুলসী পাতার প্রয়োজন পড়ে। আপনি ১৫ দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে তুলসী পাতা রাখতে পারেন, সেই পাতা শুকিয়ে গেলে সেটি প্রসাদ হিসেবেও গ্রহণ করতে পারেন।
১১) তুলসী গাছের রূপ:
তুলসী গাছ বুধ গ্রহের প্রতিনিধিত্ব করে, এই গ্রহটি কে ভগবান কৃষ্ণের রূপ বলে মনে করা হয়। এছাড়া আপনি শ্রী গণেশ এবং মহাদেব ছাড়াও প্রতিটি দেবতাকে তুলসী পাতা দিয়ে পূজা করতে পারেন।
এর পাশাপাশি লক্ষ্মীপূজায় কখনোই তুলসী পাতা ব্যবহার করা যাবে না। কেননা এখানে তুলসীকে বিষ্ণুর স্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১২) কোথায় রাখবেন না:
অনেকেই তুলসী গাছ টবে লাগিয়ে থাকেন, তবে সেই গাছ কখনোই রান্নাঘর অথবা বাথরুমের কাছে রাখা উচিত নয়। পুজো ঘরের জানালার কাছে, আপনি সেই টব সমেত তুলসী কাছে রাখতে পারেন।
১৩) বিজোড় সংখ্যার তুলসী গাছ:
অনেক সময় দেখা যায় বাড়িতে কোন তুলসী গাছ থাকলে তার বীজ পড়ে প্রচুর পরিমাণে তুলসী চারা জন্মায়। তা থেকে আবার বড় তুলসী গাছ হয়, তবে বাড়িতে বিজোড় সংখ্যার তুলসী গাছ ছাড়া কখনোই রাখা যাবে না। বাড়িতে সব সময় বিজোড় সংখ্যায় তুলসী গাছ রাখতে হবে।
আপনি যদিও ১, ৩, ৫, ৭ অথবা এর বেশি বিজোড় সংখ্যায় তুলসী গাছ রাখতে পারেন, তবে কখনোই ২, ৪, ৬ এমন জোড় সংখ্যার তুলসী গাছ রাখবেন না। প্রয়োজনে অতিরিক্ত তুলসী গাছ কোথাও দান করে দিতে পারেন অথবা উপড়ে ফেলতে পারেন।
১৪) অপবিত্র হাতে তুলসী স্পর্শ নয়:
প্রতিটি পূজা-পার্বণে পবিত্র হয়ে থাকার কথা বলা হয়েছে। তেমনি তুলসী গাছের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অপবিত্র হাতে তুলসী গাছকে স্পর্শ করা উচিত নয়।
এমন করলে দেবী লক্ষ্মীও আপনার উপরে অসন্তুষ্ট হবেন এবং আপনার ঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবেন।
তুলসী পূজার সময় যে বিষয়গুলি আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে:
যে বাড়িতে উঠানে তুলসী গাছ থাকে, সেখানে কোন বাস্তু দোষ থাকে না বলে মনে করা হয়। কিন্তু ঘরে তুলসী গাছ রাখার অনেক নিয়ম রয়েছে।
সেই নিয়ম মেনে আপনার তুলসীর পূজা না করলে ভগবানের আশীর্বাদ পাওয়া যায় না। তবে তুলসী পূজা করার সময় মহিলাদের এমন কিছু বিশেষ বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, যেগুলি অবশ্যই পালনীয়।
তো চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে:
১) সঠিক যত্ন প্রয়োজন:
প্রতিটি বিষয় ক্ষেত্রে সঠিক পরিচর্যা অনেকখানি ভূমিকা পালন করে। সঠিক পরিচর্যার অভাবে তুলসী গাছ প্রায়ই শুকিয়ে যায় এবং শাস্ত্র মতে তুলসী গাছ শুকানো কিন্তু ভালো নয়, তাই খেয়াল রাখতে হবে তুলসী গাছের আশেপাশে যেন কখনোই কোন ময়লা আবর্জনা না থাকে।
ময়লার কারণে সেই গাছ শুকিয়ে যেতে পারে। তুলসীকে দুধ নিবেদন করলে তা সব সময় সবুজ থাকে। যে পাত্রে তুলসী গাছ আছে সেখানে অন্য কোন গাছ লাগানো যাবে না। এর ফলে তুলসী গাছ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে এবং সম্পূর্ণ গাছ পাতায় ভরে যাবে।
২) জল নিবেদন ও প্রদীপ জ্বালানোর নিয়ম:
তুলসী গাছ মানেই তাতে জল নিবেদন করতে হবে এবং সন্ধ্যেবেলা প্রদীপ জ্বালাতে হবে, বাড়িতে যদি তুলসী গাছ থাকে তাহলে সকাল সন্ধ্যা দুটো সময়ে তুলসীর পূজা করা প্রয়োজন।
সকালে তুলসীকে জল নিবেদন করা উচিত এবং সন্ধ্যের সময় তুলসী গাছের তলায় প্রদীপ জ্বালাতে হবে। এর ফলে ঘরের সমস্ত বাস্তু দোষ দূর হয়ে যাবে, সংসারে আসবে সমৃদ্ধি।
৩) অতিরিক্ত জল নিবেদন নয়:
কোন কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়, আমরা প্রায়ই দেখেছি যে তুলসী গাছে বাড়ির প্রায় সকলেই জল নিবেদন করেন অর্থাৎ বেশি জল দিলে তুলসীর শিকড় নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং পরবর্তীতে তা শুকিয়ে যেতে পারে।
তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরী যে, তুলসী গাছ কিন্তু খুব একটা বেশি জল পছন্দ করে না।
তাই তুলসী গাছে জল দেওয়ার সময় খেয়াল রাখবেন গাছের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই জল নিবেদন করার। যদি বাড়ির সকল সদস্যই জল নিবেদন করতে চান, তাহলে অল্প অল্প পরিমাণে জল নিবেদন করা জরুরি।
এর ফলে গাছ ও সুরক্ষা পাবে আর তার পাশাপাশি বাড়ির সকল সদস্যও জল নিবেদন করতে পারবেন, তাই না !
৪) বাড়ির ভিতরে তুলসী গাছ লাগানো যাবে না:
বাড়ির ভিতরে তুলসী গাছ কখনোই লাগানো উচিত নয়। শুধুমাত্র বাড়ির আঙিনায়, বাগানে অথবা খোলা বারান্দায় লাগানো যেতে পারে, ঘরের মধ্যে কোনভাবেই তুলসী গাছ নিয়ে যাওয়া উচিত নয়।
৫) রাতের বেলা তুলসী পাতা তোলা থেকে বিরত থাকুন:
আমরা আগেই জানলাম যে, প্রতিদিন কিন্তু তুলসী পাতা তোলার নিয়ম নেই। এমন অনেক তিথি রয়েছে যে তিথি গুলিতে তুলসী পাতা তোলা তো দূরের কথা, তুলসী গাছ স্পর্শ করতে নেই।
যেমন ধরুন একাদশী, রবিবার এবং সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, সংক্রান্তির সময় তুলসী পাতা তোলা থেকে এড়িয়ে চলতে হয়। তা ছাড়াও রাতের বেলা তুলসী পাতা কখনোই তোলা উচিত নয়।
৬) তুলসী পূজার সময় মহিলাদের চুল খোলা রাখা উচিত নয়:
তুলসী পূজার আরো অন্যান্য নিয়ম রীতি-নীতির মধ্যে এই বিষয়টিও কিন্তু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তুলসী পূজা করার সময় মহিলাদের চুল ভেজা থাকলেও তা কখনোই খোলা রাখা উচিত নয়।
অন্যান্য পূজার মতো তুলসী পূজার সময়ও চুল বেঁধে তারপরে পূজায় বসতে হয়। এখানে আরেকটা জরুরী বিষয় বলে রাখা জরুরী যে, তুলসী তলায় যে প্রদীপ জ্বালানো হয় সেটা নিভে গেলে তা সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা উচিত।
বি: দ্র: জানা যায় যে, তুলসী পাতা কখনোই দাঁত দিয়ে চিবানো উচিত নয়। আয়ুর্বেদ অনুসারে তুলসী পাতায় পারদ থাকে, যা দাঁতকে সম্পূর্ণরূপে গলিয়ে দিতে পারে। তাই এই পাতাগুলো চিবানো উচিত নয়, এর পরিবর্তে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করতে হয়।
সকলের বাড়িতে কমবেশি তুলসী গাছ থাকলেও এই নিয়মগুলি হয়তো অনেকেই জানেনই না বলতে গেলে। আশা করি তথ্যগুলি জেনে আপনারা অনেকখানি উপকৃত হয়েছেন এবং খুশি হয়েছেন। এই নিয়ম গুলি পালন করার মধ্য দিয়ে যেমন তুলসী গাছের সঠিক যত্নে রাখা যায়, তেমনি সংসারের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বজায় থাকে আজীবন।
সেই কারণে তুলসী গাছকে সামান্য গাছ মনে করে ভুল করবেন না কিন্তু। তুলসী সম্পর্কিত বিভিন্ন নিয়ম মেনেই তবেই কিন্তু চলা উচিত। না হলে জীবনে অনেক ক্ষতি সাধন হতে পারে। সকলের জীবন হয়ে উঠুক স্বাচ্ছন্দ্যময়, মঙ্গলময়।