বিনয় বসু কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? বিনয় বসু কিভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন? ওনার বাবা-মা কে? ওনার জীবন কেমন ছিল? এছাড়াও বিনয় বসুর সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্য জানুন (Biography of Benoy Basu in Bengali)।
স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয় বসু, যার নাম আমরা এক কথায় বিনয় বাদল দীনেশ এইভাবে জেনে এসেছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় তাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আমাদেরকে সত্যিই গর্ববোধ করায়।
বিনয় বসু ছিলেন যুগান্তর পার্টির একজন বিপ্লবী, ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার রোহিত ভোগ গ্রামের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা ছিলেন প্রকৌশলী রেবতীমোহন বসু আর মাতা ছিলেন ক্ষীরদাবাসিনী দেবী।
সুচিপত্র
তাঁর জীবনী সম্পর্কে একটু ধারণা করা যাক:
- সম্পূর্ণ নাম: বিনয় কৃষ্ণ বসু
- জন্মস্থান: রোহিত ভোগ, বাংলাদেশ
- জন্ম তারিখ: ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯০৮
- পিতার নাম: রেবতী মোহন বসু,
- মাতার নাম: ক্ষীরোদাবাসিনী দেবী
- তাঁর পরিচিতির কারণ: রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ
- মৃত্যুর তারিখ: ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৩০
- মৃত্যুর স্থান: রাইডার্স বিল্ডিং
বিনয় বসুর শিক্ষা জীবন:
তার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন ঢাকাতেই শুরু করেন। তারপর তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করার পর মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন। বর্তমানে যার নাম স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ। বিনয় বসু তিনি তরুণ বয়সেই ঢাকার সুপরিচিত বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
যুগান্তর পার্টির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষাকারী একটি গুপ্ত সংগঠন মুক্তি সংঘ তে যোগদান করেছিলেন। এছাড়া বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য তার মেডিকেল শিক্ষা জীবন অল্প সময়ের মধ্যেই একেবারে শেষ হয়ে যায়।
বিনয় বসুর বিপ্লবী জীবন যাত্রা:
₹ হোম লোন • ₹ পার্সোনাল লোন • ₹ বাইক লোন • ₹ কার লোন • ₹ বিজনেস লোন • ₹ শিক্ষা লোন
বিনয় বসু কে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বিপ্লবী হিসেবে চিনি। আর সেই জন্যই ১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু, মেজর সত্য গুপ্তের নেতৃত্বে বঙ্গীয় স্বেচ্ছাসেবী নামে একটি দল গঠন করেন। সেখানে সুভাষচন্দ্র নিজে এর জিওসি হয়েছিলেন।
বিনয় ও গ্রুপের অনুসারী তার আর কয়েকজন সহযোগী নতুন বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করেন। খুব তাড়াতাড়ি তিনি গ্রুপের একজন একনিষ্ট কর্মী হয়ে ওঠেন এবং ঢাকাতে বঙ্গীয় স্বেচ্ছাসেবী দলের আঞ্চলিক ইউনিট গঠন করেন।
এরপর বন্ধু ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন খুবই অল্প সময়ের মধ্যে একটি কার্যকর বিপ্লবী সংগঠনের পরিণত হয় এবং ২০ শতকের ৩০-এর দশকের প্রথম দিকে সংগঠনটি অপারেশন ফ্রিডম শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলার বিভিন্ন কারাগারে পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানানোর জন্যই ঢাকার বঙ্গীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই ভাবে, এই রূপ নেয়।
বিনয় বসুর প্রথম আক্রমণ:
বিনয় বসু রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত এবং তিনি সেখানেই নিজের আত্মত্যাগ দিয়েছিলেন। মেডিকেল স্কুলের ছাত্র অবস্থায় থাকাকালীন বিনয় বসুকে সংগঠন থেকে তাকে প্রথম শত্রুর উপর আঘাত করার জন্য অথবা আক্রমণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৯৩০ সালের আগস্ট মাসে বিনয় জানতে পারেন যে, পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল লম্যান মেডিকেল স্কুল হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখতে আসবেন।
১৯৩০ এর ২৯ শে আগস্ট বিনয় সাধারন বাঙালির পোশাক পরে সমস্ত পাহারা ভেদ করে হাসপাতালে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং খুব কাছ থেকে লম্যান কে গুলি করেন ঘটনা স্থলেই লম্যানের মৃত্যু হয় এবং পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট হডসন মারাত্মকভাবে আহত হন।
এরপর বিনয় বসু পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে কলকাতায় দলের গোপন আস্তানায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুলিশ তল্লাশি শুরু করে এবং বিনয়ের মাথার দাম পাঁচ হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়। সুভাষ বোস এই সময় তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চাইলে তিনি তা দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
যখন বিনয় বসু কলকাতাতে পৌঁছান তখন ব্রিটিশ পুলিশ তার খোঁজে নৌকাতেও তল্লাশি অভিযান চালিয়েছিল। তারা তাদের পোশাক পাল্টে অন্য ভাবে জমিদার ও চাকর হিসেবে পোশাক পরে সেখান থেকে স্টিমারে করে তারা দমদম এসে পৌঁছান। এবং সেখানে স্থানীয় বিপ্লবী গিরিজা সেনের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন।
বিনয় বসুর রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ:
যেহেতু তাকে বিশেষভাবে খোঁজা হচ্ছে, তার মধ্যে অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই বিনয় বসু তার দলবল নিয়ে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কারাগারের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন এস সিম্পসন বন্দীদের ওপর তার অমানবিক অত্যাচারের জন্য বিপ্লবীদের চক্ষু ছুলে পরিণত হয়েছিলেন। এবং বিপ্লবীরা শুধুমাত্র তাকেই হত্যা করার সিদ্ধান্তই নেয় নি। সেইসঙ্গে সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং আক্রমণ করে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা ভয়ের সঞ্চার করতে তারা সচেষ্ট হয়েছিলেন।
১৯৩০ সালে ৮ ই ডিসেম্বর দিনেশ গুপ্ত এবং বাদল গুপ্ত, এদেরকে সাথে নিয়ে বিনয় বসু, ইউরোপীয় পোশাক পরে রাইটার্স বিল্ডিং এ প্রবেশ করেন এবং সিম্পসন কে গুলি করে হত্যা করেন।
খুবই নিষ্ঠুর কার্যকলাপের জন্য পরিচিত ট্যুইনাম, প্রেন্টিস, নেলসন প্রমূখ কয়েকজন কর্মকর্তা এমনই বিপ্লবীদের গুলিতে আহত হন। পুলিশ ও বিপ্লবীদের মধ্যে রাইটার্স বিল্ডিং এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এই যুদ্ধকে নাম দেওয়া হয়েছিল “বারান্দা যুদ্ধ” (Veranda Battle)।
বিনয় বাদল দীনেশ দের মৃত্যু:
বিনয় বাদল দীনেশ তিনটি নাম যেন একসঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিনয় বসু তার সঙ্গে বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্তকে সঙ্গী করে ছিলেন। তার সমস্ত অভিযানের সফল সঙ্গী ছিলেন বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। সমস্ত অভিযানে সফল হলেও সঙ্গিসহ তারা ঘটনাস্থলে থেকে পালিয়ে যেতে পারেননি অর্থাৎ রাইটার্স বিল্ডিং এ পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী তাদের উপরে গুলি বর্ষন শুরু করে দেয়। তরুণ বিপ্লবীরা এমনই যুদ্ধে কিছুক্ষণ এমনই ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন।
তাছাড়া পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতা আর তাদের তিন জনের ক্ষমতার কাছে খুবই ভারী হয়ে পড়ে। পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণ না করে বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং বিনয় ও দীনেশ তাদের নিজেদের রিভলভারের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু সফল হন নি, গুরুতর ভাবে আহত হন।
পুলিশের হাতে ধরা পরার পর তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৩০ সালে ১৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ দের হাতে মৃত্যুবরণ করবেন না বলে তরুণ বিপ্লবী তারা আঘাত হওয়া জায়গা তে বার বার নিজে থেকে আঘাত করে মৃত্যুবরণ করেন। এমনভাবে তিনজন তরুণ বিপ্লবী তাদের অমূল্য প্রাণ দেশের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে বিনয়, বাদল, দীনেশের নাম আমরা সকলেই জানি। এক্ষেত্রে বিনয় বসু তার সঙ্গী দের নিয়ে যে আত্মত্যাগ করেছেন সেটা বাংলায় এবং সারা ভারতেও বৈপ্লবিক তৎপরতাকে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। তাদের এই আত্মত্যাগ তরুণ দের মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলবে, চিরকাল তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। তাদেরকে স্মরণ করার জন্য স্বাধীনতার পরে ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম বদল করে বি-বা-দী বাগ (বিনয়- বাদল- দীনেশ) রাখা হয়, তাদের নাম অনুসারে।